১
ফতেহমামুদ মৌজার সরখেল
পাড়া ; নিজামির পোলারে কে না চেনে ; কিন্তু শ’বিঘার মালিক নয়া জোতদার নিজামির
পোলার গল্প শোনানোর ইচ্ছে আমার নেই বরং তার বাপ নিজামি ছিল তার চেয়েও বড় ! নিজামি উন্মাদ
হওয়ার আগে , সেই পাড়-মেখলিগঞ্জের বড় জলের ট্যাংকি যখনও হয়নি , ধু-ধু ঝাউগাছের
বালির চরার দু আড়াই মাইল নদীর ওপারে গঞ্জ তখন এত ভরাট ছিলনা ; সেই সময় বুড়িরজোত আর
হেমকুমারি ছিল নিজামির একার ; নিজামির ঝাড়ফুঁকে জল-জংলার ভুত থেকে মহল্লার বাটপার
অবধি বেপাড়া হত । চার গাঁয়ে সাগরেদ কম ছিলনা তার । পোলাপানের পেটের ব্যামো থেকে ভুরানীর সুতিকা
, সবকিছুর ওষুধ আর মন্তর ছিল ওই নিজামির জানা ; অন্তত গঞ্জের মানুষে তাই জানে । সেই নিজামি চৈত্র মাসে আখড়া খুলে
বসল ইসমাইলের চরে , খড়খড়ে শুকনো কাশবনের মাঝখানে ; দু-একটা সাগরেদ এসে জুটল ফাইফরমাশ
খাটার আর নিজামির ময়না জোড়ার কারবারি শুরু হল জমিয়ে । নিজামির ময়নাপাখি কথা কয় , ঠোঁট
ঠুকে ঠুকে শুখা মরশুম আর বর্ষার ইঙ্গিত নির্দেশ করে । ভাল আর মন্দ জিনিস সেই
ময়নাপাখি ঠোঁটের ইশারায় সহজে বোঝাতে পারে ।
সেই সনেই তিস্তার হড়কা বান গ্রাম কে গ্রাম খেলো বর্ষার মরশুম আসার অনেক আগেই ;
নদীর চর তো ছাই , গেরস্থের ঘর উঠোন ভরাট করে পাড়াগাঁয়ের বাঁশের বেড়ার ঘরে, তার
মেঝে অবধি স্রোতে একাকার ; তখন রাত বে-রাতে বিছানার তলায় কইমাছ লাফানোর শব্দ পাওয়া
যায় , পাঁকশালের তক্তপোশে কেদো কাঁকড়া এসে
জপ করার ভঙ্গিতে বসে থাকে অন্ধকারে , মানুষের সাড়া পেলে চম্পট দেয় । সেই হড়কা বানে নিজামির আখড়া ভাসল ;
নদী তার খাঁচায় সাধের ময়নাপাখিও ছাড়লনা , তাকেও নিল ! আখড়া নিয়ে নিজামির মায়া ছিল
না কোনোদিন , ঘরদোর নিয়ে চিরকাল উদাস নিজামির মন ভাঙ্গল ময়নাপাখির জন্য । অনেক সাধ
করে তাকে ধরেছিল কাতলাদহের বন-ঝোপে , পোষ মানিয়ে তাদের কথা কওয়া শেখানো মুখের
কথাটি নয় ! দিনশেষে বিধবা নিজামির মনের কথায় ভাগ বসানোর প্রাণী বলতে তো এই দুটিই ।
তাই নিজামি মাথা গেল , রাগে কান লাল করে নদীর ধারে বসে বসে জোড় বিলাপ করে সে সকাল
সন্ধ্যে , গালি দেয় নদীকে , তারপর অনেক চেঁচামেচির পর গলা বসে এলে ভাঙ্গা গলায়
ফিসফিস করে অভিশাপ দেয় ; বাঁধশেষের ন্যাড়া বটগাছের ওপর উঠে উন্মত্ত নিজামি তার শেষ
শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠত ,
‘হারামজাদা , বাটপাড়ের পো বাটপাড় , আমার পুশ্যিরে নিলি , আমি এইবার তুরে মন্তর দিমু , মন্তরে মন্তরে তরে শুঁকায় খাল বানায় দিমু , খালি চরা হইয়া পইরা রইবি , উরে হারামির হারামি নদি , সাগরে যা তুই, সাগরে যা , সাগরে যাইয়া তেজ দেখা তুর দেখি কত্ত বড় বাটপাড় ; সাগরে যা হারামজাদা !’
‘হারামজাদা , বাটপাড়ের পো বাটপাড় , আমার পুশ্যিরে নিলি , আমি এইবার তুরে মন্তর দিমু , মন্তরে মন্তরে তরে শুঁকায় খাল বানায় দিমু , খালি চরা হইয়া পইরা রইবি , উরে হারামির হারামি নদি , সাগরে যা তুই, সাগরে যা , সাগরে যাইয়া তেজ দেখা তুর দেখি কত্ত বড় বাটপাড় ; সাগরে যা হারামজাদা !’
২
ধওলিয়া নদীর মোহনা ; দূরে , নীল জলের বঙ্গোপসাগরে কেমন একটা ব্যাস্ততায় মিশে
গেছে নদী। পিচ্চি বয়সে বেড়াতে এসে একবার বুড়িবালামের
মোহনা দেখেছিলাম দূর থেকে , নিজামির আখড়ার পত্তন তখনও হয়নি আমাদের গঞ্জে,
বুড়িবালামের কাছের সাগর ছিল নীল আরও নীল আর ছোটছোট মাছধরা নৌকারা কেমন ব্যাস্ততায়
ঢেউ ভাঙ্গে, কেমন অসীম শ্রদ্ধায় মরশুমের প্রথম মাছধরা নৌকা ছাড়ে দিগন্তের দিকে ;
মানুষের বশ মানানোর সাধ আর জিঘাংসার গল্প হয়ত তার অনেক সহস্র শতাব্দী আগের ! সাগরের
কাছাকাছি নোনা ঘ্রাণ তীব্র বরং মোহনার ভেতরের দিকে টা অনেক সুমিষ্ট , গাঁও গঞ্জের
খালবিলের কাদামাটির গন্ধভরা তার বাতাস ; কত বছর আগেকার কথা মনে করে নদী ; কত বছর
আগের কথা মনে পরে নদী ?? তিস্তার ধারে আমাদের রূপকথার সন্ধের মতন রাত্রি নামে অনেক
সন আগের কথা ; হ্যাঁ ঠিক এইরকম বিকেল গড়িয়ে সরখেলপাড়ায় সন্ধ্যা আসে জিঘাংসার শতকে। যেসব জেলেরা সাদা ধপধপে জালে মাছ
ধরে অথবা সাগরের কাছাকাছি নরম বালি খুঁড়ে গচি কাঁকড়া খোঁজে , যাদের সারাশরীর মৃত
মাছেদের গন্ধভারাক্রান্ত তারা কেউ নিজামির কথা জানেনা , তারা জানেনা যে নিজামির
মন্তরের গুণ জিতেছে কিন্তু নিজামি হেরে গেছে ; সেইবার নদী সত্যি শুকিয়ে কাঠ হল
ঠিকই কিন্তু তার দায় ছিল ওদলাবাড়ির নয়া বাঁধের । সেই গ্রাম্য ওঝার আর প্রতিশোধ নেয়া
হয়নি । প্রতিশোধ নিয়েছে তার জব্বর মন্তর ! জেলেরা ঝপাঝপ জাল ফেলেই চলছে , তারা
চাওল মাছ ধরে , ধরে মৃত ঝিনুকের খোল , জৌলুসহীন প্রবাল আর ধরে অচিন সমুদ্রের রঙিন
মাছের ঝাঁক আর আবর্জনা , ভোর হওয়ার আগে সেইসব মাছদের নিলামি হবে আড়তে আর একবিংশ
শতাব্দীর ক্ষুধা মেটাতে তারপর চালান হবে বেনামী শহরে-বন্দরে-সীমাহীন বুভুক্ষু
মানুষের লোকালয়ে ! তারা নিজামির গল্প জানবেনা , জানবেনা তার ময়না হারানোর গল্প আর
নদীর কথা । জানবেনা মানুষের স্লাঘাহীন মারণ মন্তরের কথা ! নদীরা যেমন মোহনার কাছে
বড় অসহায় , যেমন মাথা নামিয়ে মিশে জেতে চায় , তার সমস্ত প্রবাহের গল্প ভুলে গিয়ে নিজেকে
অস্বীকার করার অভিমানে , মানুষেরা তেমনভাবে সমস্ত শুখার দিনের কথা ভুলে এ কোন দিকে
চলছে ‘দরবেশ’ নিজামিকে জিজ্ঞেস করার বড় সাধ হয় !! নিজামির ভুল ভেঙেছে কিনা কেউ
জানেনা, তার সাথে সাক্ষাতও হয়নি বহুকাল ; সেইদিন ধওলিয়া নদীর মোহনায় কেউ যদি দূর
দূর কিছু ছায়া মিলিয়ে যেতে দেখে তার একটা
নিজামির হতেই পারে , যে নিজামি কখনও আর নদীকে গালি দেয়না , যে কখনও নয়া বাঁধের
গল্প শোনেনি , শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি !!
০৭/০৮/১৬
১২/০৮/১৬
১২/০৮/১৬
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন