বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

কমরেডের মৃত্যু



কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যু হয়েছে ।
কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যুর খবর উত্তর পাহাড়ের গ্রামে এসে পৌঁছল বেশ কিছুদিন পর ।

বুড়ো রডরিগো গঞ্জালভেজ’কে তোমরা চেননা ; চেনার কথাও নয় । কর্নেল আলবার্তো বাসিলিও গুইদোর শেষ নারকীয় অত্যাচারের শিকার এই গ্রামেই প্রথম খেতমজুরের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে স্বপ্নের মত সুন্দর সেইসব এপ্রিলের দিনে ! ছাব্বিশে এপ্রিল মারিনালাদার যুদ্ধে মৃত প্রত্যেকেই এই রডরিগো গঞ্জালভেজের বন্ধু ছিল , প্রেমিকা ছিল । তেত্রিশ বছর আগের সেই বসন্তে মুক্তিদিনের গানে ভরপুর সারাটা পাহাড় আগলে গুইদোর সেনার বিরুদ্ধে লড়েছিল হেরেরা আর তার সাথি খেতমজুরের গেরিলা বাহিনী !
কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যুর আরও দিন সাতেক পর রাজধানী ফেরত বুড়ো গঞ্জালভেজ সেই এপ্রিলের যুদ্ধ-উপত্যকা পার হতে হতে পেড্র মাচুকার কথা ভাববে , ভাববে যুদ্ধদিনে মৃত্যুর আগে ফিশফিশিয়ে বলে যাওয়া ক্ষীণ অথচ গভীর কিছু ভয়ের কথা ,
‘যেখানে পার পালাও , গুইদোর সেনার সামনে আমরা তুচ্ছ, আমরা হেরে যাওয়া যুদ্ধে লড়ছি জ্যুয়ান ’
বাঘের মতন দর্পে সেদিন রক্তমাখা ফাটা হাতের তালুর ওপর হাত রেখে কমান্দান্তে আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরা বলেছিল মারিনালাদা - মাদ্রিদ - সালামাঙ্কা – গ্রানাডার - স্যান্তিয়াগোর লাখ লাখ কমরেড পেদ্র মাচুকার রক্তের দাম দেবে বীরের মতন লড়ে ! বসন্তের যুদ্ধে শহীদ পেদ্র মাচুকা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে !
রডরিগোর ঘোর ভাঙ্গে উপত্যকার মধ্যে সারি বেয়ে চলা খচ্চরের ঘণ্টায় । বন্দুক , বই আর শস্য বয়ে ওপরের পাহাড়ে ওঠার কষ্ট নেই আর এদের ; বাহারি জুতো , রঙ্গিন জামাকাপড় , বোতলবন্দি দক্ষিন উপকুলের সেরা অলিভ , ট্রান্সিস্টার রেডিও আর সুগন্ধি সাবান উঠছে খচ্চর বয়ে পাহাড়ের সবকটা বাজার জমকালো করতে ।
মারিনালাদার পাহাড় নিয়ে আর কিছুই অনুভব হয়না তার ! স্যাঁতস্যাঁতে , বিধ্বস্ত আর বান্ধবহীন মনে হয় রাজধানীগামী রেলকামরার মত । যেমনটা কামরার গিজগিজ করা ভিড়ে মুখগুলো চেনা-ভয়ে জুবুথুবু সেইরকম ভয় হয় এই উপত্যকায়  ; সেইসব মুখ – যেন এক একটা পেদ্র মাচুকার মুখের আদল কিংবা তার প্রেমিকা অথবা পরিবারের মতন , তার বন্ধু আর বড়ভাইয়ের মতন ! এরা শুধু মানতে পারেনা উত্তর অববাহিকার জমি উর্বর , এরা মানতে পারেনা গোটা স্পেনের গোলা এই উত্তরের জমিন । বুড়োর মাথার ভিতর একটাই প্রশ্ন ঘোরে শুধু - উত্তর থেকে লোকে কেন দক্ষিণের রুক্ষ শহরগুলোতে দলে দলে ছুটছে ? কমরেড হেরেরার শোকসভায় নাকি অন্য কোথাও ? রেলগাড়ি অন্তিগালা পার হতেই কামরায় ভিড় বাড়ায় ওয়াগন ইউনিয়নের লোকেরা , হাত-মুখ-কাপড় কালিতে ভরা । তাদের হতাশ মুখ দেখে রডরিগো শোধরাতে যায় কেউ মাদ্রিদ যাচ্ছে কিনা কমান্দান্তের শোকসভায় । সারা স্পেনে সবকটা স্কুল আর আপিসে এক সপ্তা ধরে রাষ্ট্রীয় শোকের আয়োজন করছে , লাখ লাখ লোক উত্তর থেকে নেমে আসছে মাদ্রিদ , নিশ্চয়ই সকলে কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরাকে শেষবারের মত দেখতে যাচ্ছে ! ওয়াগন কর্মীদের কোন সাড়া পায়না ; কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যু এদের একটুও ছুঁয়ে যায়নি দেখে সে অবাক হয় , যেচে মারিনালাদার বসন্তের যুদ্ধের গল্প করতে থাকে অতঃপর পরের স্টেশন এলে ওয়াগন কর্মীরা নিরুত্তর নেমে যায় ভিড় ঠেলে । মাদ্রিদগামী ক্লান্ত কামরার ভিড় , মুরগির খাঁচার গন্ধ , শিশুর কান্না আর শুঁকিয়ে যাওয়া অনিশ্চয়তার মুখগুলির মধ্যে রডরিগো কাউকে খুঁজতে থাকে তার সব প্রশ্নের উত্তরের জন্যে ! এমন সময় চেকার ওঠে রেলপেয়াদা নিয়ে ।

তেত্রিশ বছর পর বসন্ত যুদ্ধের উপত্যকা পার হতে হতে তার আর নতুন কিছুই অনুভব হয়না এখন ! রেলপেয়াদা যখন টিকিট না থাকার অপরাধে বসন্ত যুদ্ধের গরিলা সেনা রড্রিগো গঞ্জালভেজ আর তার সহযাত্রীদের ধরে নিয়ে যায় , বুড়ো তখন চেঁচাতে থাকে , বসন্ত যুদ্ধের গল্প বলতে থাকে , উত্তর পাহাড়ের প্রত্যেকটা র‍্যাঞ্চ তারা রাষ্ট্রের নামে যেদিন লিখিয়েছিল কমান্দান্তে হেরেরার নেতৃতে সেইসব গল্প বলতে থাকে ! রেলপেয়াদা নিরুত্তর টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায় , প্রিজনকামরায় চালান করে । উত্তর পাহাড়ের ওকগাছের জঙ্গল ভরা গ্রামগুলোর বাইরের পৃথিবীটা কত বদলে গেছে সেই মাপযোগ  করতে করতে রডরিগ গোঞ্জালভেজের মুখ লাল হয়ে ওঠে ; তার রাগ হয় নিজের কথা ভেবে , কামরার প্রত্যেকটা পেদ্র মাচুকার আদলে মানুষের কথা ভেবে । খচ্চরের পিঠে মারিনালাদা বসন্ত যুদ্ধের উপত্যকা পার হতে হতে প্রথম প্রেমের মতন ঝাপসা, অচেনা আর বুঝতে না পারার চিরসংঘাত মনে হয় বসন্ত যুদ্ধের গল্প , পেড্র মাচুকার শেষ কথাগুলো নিয়ে আফসোস হয় রাজধানী ফেরত হিডালগো রড্রিগো গঞ্জালভেজের , কমরেড হেরেরাকে বিশ্বাসঘাতক মনে হয় !
(ক্রমশ) 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন