দুপুরের রোদটা নেমে এলেই ভিড় জমে ওঠে এখানে । বাসের নিত্যযাত্রী – বাদামওয়ালা – পাবলিক ওয়াশরুমের লোকজন বাদেও আরও প্রচুর মানুষের ঢের আনাগোনা । প্রেমিকযুগল এবং ইতিউতি বেকার – আড্ডাপ্রিয় জনতা সংখ্যায় বেশি । একটা বাসস্ট্যান্ড জুড়ে এরকম মিলনক্ষেত্র আগে দেখিনি ! বর্ষা ঢুকেছে শহরে সদ্য । বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মাস শেষে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কতগুলো বছর কেমন কেটে গেল । এখন স্কুলের পরীক্ষার মরশুম শেষ । এ’কমাস টিউশান বন্ধ তাই মন্দার বাজার । স্টাফ ক্যান্টিনে বাকির চেহারা তিন অঙ্কে তরতর করে বাড়ছে । ইস্ক্রা পঞ্চান্ন টাকা , মাশ্রুর দুশো ছল্লিশ , আইডিয়াল মোমো কর্নারে একশ ষাট , তিরুমল গতসেমের দেড়হাজার , কোরক সেকেন্ড ইয়ারের বারশ
! আর ভাবা যাচ্ছেনা ! এইবার একটা পার্টটাইম কিছু না-দেখলেই নয় । বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা দিনদিন কমছে গ্রেড পয়েন্টের মত । মাঝে মাঝে স্বপ্নে পাওনাদারেরা আসে কেউ থারমো’র প্রফেসর হয়ে , কেউ কেম-রিঅ্যাকশানের প্রফেসর হয়ে কিংবা যে-লোকটা ফাই-কেমের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সে আসে হাতে গ্রেড কার্ড নিয়ে ; কাজিরাঙ্গার সবচেয়ে ধূর্ত শেয়ালের মত মুখ করে সিএইছচ-থ্রি
ফাঁকা রুমে একলা আমার মুখোমুখি বসে বলে হয় ধার মেটাও নাহলে এই-সেমে আরও দুটো সাপ্লি এক্সট্রা ; স্ট্যান্ডার্ড ! তিননাম্বারে বাচ্চার দোকান এড়িয়ে পথচলার মরশুম এটা ; সিগারেটের বাকি এখনো মেটানো হয়নি । মেসের প্রত্যেকেই দেউলিয়া । চারটে ধার-সন্ধানী প্রাণী একঘরে থাকলে যা হয় ; তাদের সব্বার হাল আমার মতনই । আলু সেদ্ধ করে পাঁচফোড়নে ভেজে ওপরে ভাপা সবুজ বরবটি ছড়িয়ে দিব্যি ‘ইতালিয়ান খাবার’ নাম দিয়ে সহজেই মুখ বুজে খাওয়া যায় এইবেলা । ফাঁকা পকেটে কেমন করে যে চলে অর্ধেক মাস ; কে যে স্পন্সর করে , চারটে ব্যাঙ্করাপ্ট বুঝে ওঠেনা কখনই ; তবে জালি ‘ইতালিয়ান’ , ‘ফ্রেঞ্চ’ , ‘মাদাগাস্কারের’ ডিশ নাম করে তিনটাকার বাটার দেয়া কল্মি সেদ্ধ , পেঁপের স্টু , মুলোর সালাদ অথবা পটলের সুড়সুড়ি ভাজায় হাফ পাউন্ড এক পাউন্ড রুটি বেশ চলে যায় ! তারপর মাস শুরু হলে অথেন্তিক বাঙালি খানাপিনা চলে আর ধার মেটানো সাথে । গোটা মাসের গল্পটা শেষ তিনবছরের মত যেন । তিরুমলের , মাশ্রুর , কিস্কু , তাতাইয়ের কিছু ওড়ার গল্প খেলার মাঠ , সিঈটি , আশীর্বাদ আর ঝিলের ধার ; আরও কতক দেয়ালে , অনেকগুলো বন্ধু মিলে রাতজাগা অনেকগুলো রাত্তিরের হলুদ আলোর এক দুই তিন চারে , সিএল মোড়ে চলন্তিকায় ; গল্প লিখে শেষ করা যায়না এমন সব গল্পে ; খুব – তারও বেশি দ্রুত ,তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়া সময়ের সাথে সাথে । সেদিন মিছিলে আরেকটা মুখ ; পুরাতন জামা , জিন্সের ইতিহাসের চেয়েও প্রাগৈতিহাসিক রঙহীন প্যান্ট পড়া যুবক গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে , পৃথিবীর আর সমস্ত পাওয়া না-পাওয়ার কথা ভুলে স্লোগান ওঠালে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে ! এসসি মল্লিক রোডের মাঝে ভনিতা করে টাঙ্গানো লাল পতাকার সারি , লেলিনের মূর্তি – কারো কিসসু আসে যায়না । বিপ্লব’দা ; বিপ্লব’দার অনুবাদ, তার লেখায় অনেকটা ইউরোপ – লাতিন আমেরিকা ঘোরা হয়ে যায় – আরও কত নিজের চেনা-অচেনা গলিঘুপচি । মুক্তমানুষ কম দেখেছি ; যদি সত্যিকারের মাথাউঁচু করে বাঁচা , দাসত্ব না করে বাঁচা বড় স্পর্ধা হয় , আমি সেই মিছিলের মুখ আর পৃথিবীর বিপ্লব নায়ক হতে চাই ! অঙ্গন প্যারিসে , ঘন্টু ম্যানেজার হয়ে যাবে , আর যারা স্টার্ট আপের প্ল্যান বুনছে তারাও অনেকদুর – সমুদ্দুরপাড় । আইডিয়াল মোমো কর্নারের মালিক , তারপর ওপারে তেলেভাজার দোকানি , নচিকেতা টি-স্টলের দাদা , ধোসার দোকানের মহিলা , মশলামুড়ির দোকানদার , কাঠের কারিগর – বড় সড়কের চায়ের দোকান , তেলেভাজার ভিড়ের রেগুলার লোকেরা প্রত্যেকে যারা এক একটা মৃত স্বপ্নের জীবাশ্ম বয়ে চলছে ; যাদের কিছু চাওয়া আছে , না-পাওয়া তারও ঢের বেশি অথচ তারা সুন্দর হাসতে জানে , কাঁদতেও ; পৃথিবীর গাঢ়তম অন্ধকারের সন্ধ্যেয় তারাই দুধারে ফুটপাথ আলোকিত করে রোজ মরে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠে ; একটা মৃত্যুর বীজ থেকে আরেকটা দোকানি , আরেকটা মুটেমজুর, আরেকটা কর্মহীন বেকার বৃদ্ধ- মাঝবয়স্ক ঘুম ভেঙ্গে আবার বেঁচে ওঠে – দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় ! শনিবারে দু’নাম্বার গেট বন্ধ হওয়ার আগেই সিএল চলন্তিকা , ব্লু-আরথের সামনের কৃষ্ণচূড়ার আভিন্যু পাড় করে সিইটি ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠবো । আসমা পারভীন , তাকে পাঠানো আরেকটা নিরুত্তর মেসেজের জন্য অপেক্ষা করবনা একটুও ; “ গন্তব্য আমি জানিনা আমার , তুমি জাননা আমারও ; তুমি, যাকে ভালবাসা যেতে পারতো , সেকথা তুমি জানতে ধরো ... “
ছুটতে ছুটতে কোনওমতে শেষ উত্তরগামী ট্রেনে চেপে ঘরমুখো হব ; আর কক্ষনো ফিরবনা জেনে এইখানে । জুলাই মাসের সন্ধ্যেবেলা আশুরগড়ের ঝিলে ব্যাং ডাকবে ; আমি কাদার রাস্তা ভাঙতে ভাঙতে শামিলারবসতের ধঞ্চেগাছের ক্ষেত পেরবো , আমন ধানের জলে শ্যাওলার গন্ধ নাকে আসবে বরশাতি বুনো মাধবিলতার ঘ্রাণে বিতলটারির আমবাগানে কালো অন্ধকারে নীল জোনাকির জঙ্গল ঠেলে ঘরে ফিরব । সেদিন রাঙ্গাপিসি জিজ্ঞেস করবেনা চাকরি পেলুম কিনা। বাবা মার্কসীট দেখতে চাইবেনা ; মা তার দোতলা বাড়ির স্বপ্ন ভুলে যাবে। পাটপচা পুকুরের গন্ধ সুমধুর হবে । বিটলটারির আকাশে সেদিন সুন্দর কালপুরুষ ; তার চেয়েও সুন্দরতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকবে !
- সেইসব বন্ধুদের , যাদের ছাড়া কলকাতা জনহীন মনে হয় ।