রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

পিরীচপুর ১


পিঞ্জিরীগঞ্জ ফিরৎ সদাগরী নাও ,
"ও বগার পো  বগা , পচ্ছিমে যুদ্ধ লাইগছে শুনছ ? " নাসীরচা চিল্লাইয়া কইলো 
মাঝবাওরে বগদুল্লা হাঁ করি চায়া আবার জাল টাইনতে থাকে 
"কাম নাই কুফার যত্ত খবরের ঢং "
ভুটভুটি নাওয়ের শব্দ জলের শব্দ মিইশ্যা হার্দুলেরঢিপি ঐদিকার পানাজলায় হারায় যায় মরশুমী পাখির বাসার ভিতর। 
আইজকেও মাছ নাই।  মাঝে মাঝে মনে হয় পৌষমাসে পাখির প্যাট বাওরের মতন বড় হয় আর সব মাছ অগো প্যাটে ঘুমায় চৈত্তির অব্দি ; বগদুল্লা আবার জাল ফ্যালে , লম্বা সরু রোগা গলা নিয়া  জালের পানে এমন চায়  যেন মহল্লার পুরান বগা !
পচ্ছিমে যুদ্ধ তা আমাগো কি ! এই তো বাওরের পূব থিক্যা পচ্ছিম পুরাই ছিমছাম , শান্ত ; সকাল বিকাল ডজন ডজন নাও যায় , নাওয়ে লোকজন যায় আসে।  কারুর কিছু যায় আসেনা।  এই গোটা জিলায় ওই নাসীর অর চৈদ্দগুষ্ঠি আকামের  পোলা নাসীরের যত চিল্লান বেল্লান !

সেই রাইতে বগা সপ্ন দেখল ।
বাওরের পচ্ছিমেই যুদ্ধ , হককথা কৈসে হালায় নাসীর ! 
গঞ্জে গঞ্জে সব মরদ পালাইতাসে আরব দ্যাশে , এককুয়া মতন খুইরলেই নাকি আরবে ভুটভুটির ত্যাল , খাবার আর হল্লাহীন বসতির অভাব নাই আরবে । আর এই সারা কিশোরগঞ্জ , আবগারীপারা , মুনসীরডোবায় তুমুল যুদ্ধ ; রোজকার নাওভর্তি লোকজন  যেসব যায়  আসে তাগো কারো  ছোখে সুখ নাই , সব্বাই পালাইতে চাই , জাহান্নমের কীটের মতন কিলবিল করে মহল্লায় মহল্লায় মাইনসের হা-ভাত , ধান্দাবাজি ।   যুদ্ধখান কি কারণে সেইডা আন্দাজ করা কঠিন কাম বটে , আর মাইনসির জিউ ! রক্ত নাই , গোলাগুলি নাই ,  চিইপা চিইপা ধুইক্যা মরে বচ্ছরভর , সকালে বাঁচে আবার মরে এমনি শয়তানের ফিরিন্দী , যুদ্ধ হইতাসে ট্যার পাওন যাওয়া মুশকিল বটে ! কেডা একতাল বিষ দিসে  বাওরে সেইরাইতেই , সেই দেইখ্যা বগদুল্লার চোখে পানি আইল ;  মরশুমি পাখি মরসে তো মরসে, তাগো প্যাটের সব মাছও অক্কা  ! পিঞ্জিরীগঞ্জের বাওরভর সেদিন চকচক করতাসে মইরা ভাসা মাছের গতরে আর গন্ধ ; বগা পা বাড়াইলো বাওরে , পানিতে নাইমা হাইটতে হাইটতে মাঝ বাওরে গিয়া তার মাথা গ্যালো গ্যালো , আল্লারে আল্লা একী কান্ড , বাওরের পানি কই  গ্যালো সব ! দক্ষিন দিক উথার পাথার পানি এক চরু আইসা ঠ্যাকে যে , মাঝি মল্লার দল মাছ ধরবো ক্যামনে আরবচ্ছর !! 
এমন সময় , আন্ধারে  কেডা  চিল্লায় যেন , 
নাসীরচা না !  ব্যাটা কেমন হাসে দেখো  সয়তানের উজিরের মতন আরো চিল্লায় কিছু কয় , বুঝা যায়না  , মাথা ঝিম ধরে কেমন মাছপচা বদবু আর গইলা যাওয়া মরশুমী পাখির প্যাট ইতিউতি । 

রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হাসানের গল্প



পেঁপে আবিষ্কার ও লংকা-কাণ্ড ।
শিরোনাম এটাই হওয়া উচিত ফরিদুল হাসানের কথা বলতে চাইলে ।
গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে গেল । মাইনর স্কুলের ছুটি মানেই একমাসের কমে থামার নামধান্দা থাকেনা । বাচ্চা পোলাপান কম ছুটিতে পড়বে কেমন করে আর দুটো আম-লিচু খাওয়া , পাড়ায় পাড়ায় দৌরাত্ম্য করে না বেড়ালে স্কুলের ক্লাস কাটিয়ে সেসব করবে যে ! তাই ঢের ছুটি অবাস্তব হতেই পারেনা , বরং বুদ্ধিমানের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি উত্তম বন্দোবস্ত এটি। মোদ্দায় এই হল জাস্টিফিকেশন আমাদের কাছে । জ্যৈষ্ঠমাসের গরম যত বাড়বে , লিচুর ঝাড়ে ততবেশি রঙের খেলা , সবুজ লিচুর গায়ে খানিক রঙ দেখা দেবে প্রথমে , তারপর পাকতে পাকতে লিচু যত লজ্জা পাবে তত রঙ গাঢ় হবে , টইটুম্বুর লিচু রসালো অন্তরভাগ নিয়ে গরম সইবে ; দোল খাবে বিকেলের ঠাণ্ডা হাওয়ায়। ঠাকুরদাদা বয়স্ক ব্যাক্তি , সবুর করার ধাত একটু বেশিই ; ফলত দিনের বেলা লিচু পাহারা ও রাত্তিরে পুরান মশারি ঢেকে , পাড়া-পড়শির গভীর রাতের ঘুম ভণ্ড করে টিন বাজিয়ে বকদুল , রাতচোরা ইত্যাদি লিচুর ধান্দায় ঢুঁ-মারা পক্ষীকূল ভাগিয়ে তার ওই টইটুম্বুর অন্তিমভাগের পরিণত লিচু চাই-ই চাই । দিনটা শুক্কুরবার ; সকালের জলখাবারের পর থেকে বহু চেষ্টায় মৃদুপক্ক লিচুলাভের সকল প্রচেষ্টা বিফলে গেল ; ষষ্ঠীদাদা , তিকেন আর পম্পিদিদির সাথে গম্ভীর ‘গোলটেবিল বৈঠকে’ ঠিক হল ঠাকুরদাদার গোসলের সময়টা টার্গেট করা বিচক্ষণের কাজ বটে ! দক্ষিণঘরের বেরার ফুটোতে ওৎ পেতে বসে আছি তার গোসল-যাত্রার অপেক্ষায় , এমন সময় গোটা বাড়ি শোরগোল ফেলে কে যেন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, কিছু বোঝার আগে চেয়ে দেখি একজন ঠাকুরদাদার গলা ধরে কাঁদছে, খানিক বাদে তারও কান্না শুরু । ঠাকুরদাদাকে আমরা কেউ কাঁদতে দেখিনি , সাথের লোকটিও অচেনা । সম্বিৎ ফেরার আগেই লক্ষ্য করলাম সাথে আরেকটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি ও আমাদের বয়সী ছেলে । প্রায় আধঘণ্টা সময়পর ক্রন্দন-পর্ব সমাধা হলে দেখা গেল বাড়ি ভেঙ্গে সব লোক জড় হয়েছে । চোখের জল মুছে ঠাকুরদাদা বীরদর্পে আয়োজনের ফরমায়েশ নিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠল ; প্রকাশ মাছ ধরতে গেল , বাড়ির গৃহিণীরা ভালমন্দ রান্নার বন্দবস্তে ব্যাস্ত হল। খানিক বাদে বোঝা গেল কানাঘুষোতে , সেই লোকটি হাসানচাচা ! জন্মের পর থেকে আমাদের একান্নবর্তী কালেক্টিভে প্রত্যেক সন্ধ্যেয় একছিল সুর করে পড়া ধারাপাত আর এই হাসানচাচার গল্প , যতক্ষণ না আটটার ট্রেন দশক্রোশ দূরে কাশিয়াবারিতে হুইসেল বাজায় ! সাতচল্লিশের আগে আমাদের বাড়িটাই ছিল হাসানচাচার বাড়ি । দেশছাড়ার সময় আমাদের নীলফামারীর ঘরের মালিক হল এই হাসানচা । তার মামাবাড়ির দ্যাশ হল ওই মেখরটারি ; কমবয়সে ঠাকুরদার সাথে তার বাইচের দলে মোলাকাত , সেই থেকে দোস্তি ! সেই হাসানচাচার ছেলে হল ফরিদুল হাসান । জমির মোকদ্দমায় ভিটেমাটি যাওয়ার জোগাড় , হাসানচা’র এইমুলুকে আগমন মামলার ক্যাপিটালের ধান্দায় । ছোট হাসানের সাথে দোস্তি সেই বিকেলেই ; তার ডাংগুলি খেলার নিপুণতায় হুব্বা সবাই , এক দানে বিশফুট দূরে নড়ি ছুড়তে পারে আর লাট্টু ফেঁকার কায়দা তো লা-জাবাব ! পরদিন দুপুরে খামিরের দিঘিতে সে ডুবসাঁতরে দুই মাথা জলে শোল ধরল ; সেই থেকে ফরিদুলের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে ওস্তাদি কবুল করল মহল্লায় বাচ্চা-কাচ্চা। হাসানচাচার অর্থসন্ধান কর্মকাণ্ড বেশ দীর্ঘ হতে লাগল , সাথে ফরিদুলের সাথে দোস্তিও । বড় হাসান আমাদের সম্পর্কে চাচা নাহলেও , বাপ-জেঠার গল্প শুনে আমরাও কেমন হাসানচা বলা আরম্ভ করেছি । ফরিদুল তার তৃতীয় সংসারের পোলা । বাকি দুইটি মা তার গত হয়েছে ঢের আগে । একদিন সকালে ছোট হাসান ঠাকুরদাদাকে ধরলে বাশবাগানের ওই লাউমত ফলের ঠিকানায় । ও ফল যে বাংলাদেশের নয় সে নিয়ে নিশ্চিত ; গোটা রংপুর , নীলফামারী , ডোমারে এই ফল তো কেউ দেখে নাই ! জানা গেল ও ফল ফিরিঙ্গীর দান । হলদিবাড়ির যে র্যা লে সাহেবের রেলগুমটী পাটের গুদামের , সেইখানে হরদম এই পেঁপেগাছের জঙ্গল । সাহেবসুবো গর্মির দিনে তার পাকা ফলে নুন মাখিয়ে ফলার করে , অধুনা যা মেলার মাঠ সেইখানে , এলাকার সবকটা তামাকের কোম্পানি , পাটের কোম্পানির ফিরিঙ্গী এক হয়ে আড্ডা দেয় সেই ফল খেতে খেতে ; গুলঞ্চের ছায়ায় সফেদ কাপড়ে ঢাকা টেবিলে সাজিয়ে রাখে , গল্প করে । সে যে বিষফল নয় , তার প্রমানে শুরু হল পেঁপে দিয়ে অতিথিসেবা ওই মধ্যাহ্নেই ঠাকুরদাদার তলবে ! দুপুরে পেঁপে সর্ষে , পেঁপে পাঠা , পেঁপে টক; রাত্তিরে পেঁপের ডাল , কাঁঠালের বীজের সাথে পেঁপে ঘণ্ট , পেঁপে পুঁটি প্রভৃতি ! স্বাভাবিকভাবেই পরদিন তাদের শুরু হল পেটগর্মি ! দুই হাসানের আর একটুও সন্দেহ রইলনা যে সেই ফল বিষফল অতি অবশ্যই ! ইতিমধ্যে হাসানচাচা কিছু অর্থসন্ধানে সমর্থ হলেন ; তার ঘর ফেরার দিন এলো কিন্তু হাসান ফেরা হলনা । দেশে বিবাদের শেষ নাই , আত্মিয়-কুটুম্ব , ভাই-ভাইজানে লড়াই বড় । ফরিদুল রইল নুরুলের-টারিতে চাচার কোন ফুপাতো বোনের বাড়ি । মহাল শান্ত হলে ফের ফরিদুল ফিরবে তার মুলুকে । সেই শুরু আমাদের আহ্লাদের দিনরাত্রি । হাসান ভর্তি হল আমাদের মাইনর স্কুলে । ঘুঘুমারির দহলায় সে যায় কম , ঘুরি ওড়াতে । মহল্লায় শিরীষ গাছের সারি ধরে , পুঁই গাছের মাচার পাশ দিয়ে তার ঘুরি ওড়ানোর ধান্দা বেশি । সে বলে অত উঁচুতে উড়িয়ে মজা নেই । যত কম খাঁড়া , গাছগাছালির মাঝে ঘুড়ি ওড়ানোয় বেশি মাথা লাগে , মজাও ! তার মতন জঙ্গল ঝাড়ের মাঝে ঘুড়ি ওড়ানো এপাড়ায় কারো সাধ্যি নেই । বর্ষালী দিনে হাসান এসে ভামবিড়ালের ডাক দেয় মাঝরাতে , পা টিপে টিপে পেছনবাড়ির দোর খুলে ডেকে নিয়ে যায় মাছ ধরতে , হাতে টাঙ্গি আর পুরান রিক্সার টায়ার , কখনও মন্ডলঘাট – সিপাইপাড়া তো কখনও ভোলারহাট আরও দূর । ভোর হওয়ার আগেই ঘরে ফেরা । মাঝরাতে দূর অবধি আকাশ নেমে যাওয়া দহলায় নিজেদের প্রেত মনে হত ! মাঝে মাঝে টায়ারের মশালে পোড়া গন্ধ অসহ্য হয়ে এলে নিভিয়ে দিই ; কালিডাঙ্গায় দূরে কালো মেঘ জমে এলে ভয় করে তখন , লোম খাঁড়া হয় দহলার শিরশিরে বাতাসে , বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হয় খুব । হাসানের এত কিছুর টাইম নাই , তার মাথায় যেন কীসব ভর করত , মাছধরার ঘোরে পাগল হাসান তখন কথা বলত না ! ওইমতন এক রাত্তিরে কুম্বারির রেলপুল পার হয়ে কোথাও পৌঁছে গেছি , কারো কোন হুশ নেই, রাত দুটো পার হয়েছে হয়ত ! খোলোই পুরো ফাঁকা ; মাছ মিলছেই না আজ , হাসানের মেজাজ গরম । অমাবস্যা কিনা জানা নেই তবে কৃষ্ণপক্ষ চলছে সেটা নিশ্চিত । আরও দহলা পার হই আমরা , কাশিয়াবাড়ির ডাঙ্গা আসে তারপর পাঙ্গার সোঁতা ; দূরে গাঁয়ে কুকুর কেমন সুর করে কাঁদে , পায়ের তলায় ঠাণ্ডা কিছুর ছোঁয়া লাগতেই বুকভেঙ্গে চমকে উঠি ; ভয়ার্ত হাসান চমকে উঠে আশ্বাস দেয় ও ব্যাটা জলঢোঁড়া ছাড়া কিছু নয় , সে গুণগুণ করে গান গাওয়ার চেষ্টা করে । ডাঙ্গায় হোগলার বন মান্দার গাছের ঝোপ পেরোতেই পাঙ্গার নাগাল মেলে । টাঙ্গি নিয়ে খোঁজাখুঁজি চলে আবার , টপাটপ বোয়াল মিলছে , কাছেই কোথাও শ্মশান নিশ্চয়ই , নাহলে বোয়ালের এত দাগি চেহারা কে কবে দেখেছে , হাসান বলে ওঠে । তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেটে গুঁতো দিল হাসান , ইশারায় দূরে তাকাতে বলল , চেয়ে দেখি চার-পাঁচটা আগুনের গোলা প্রায় চার সাড়ে চারশ মিটার দূরে নদীর এপার থেকে ধীরে নদীর ওপারে যায় , মাটির খানিক ওপরে সবকটা গোলা , তখন ভয় নেই , কি ছিল কিছু বোঝার মতন অবকাশ ও নেই , শরীর অবশ লাগে , মাথা ঝিমঝিম করে গলা শুকিয়ে আসে আর নিজের অজান্তে খাঁড়া হওয়া লোম ; পা কাঁপছে । হাসান আবার গুঁতো দেয় , আমার হাত থেকে মশাল নিয়ে এগোতে থাকে কিছু না বলে , আমি অদ্ভুত ইশারায় তার পিছু ছলা শুরু করি , মাছের খোলোই কোথায় ফেলেছি মনে পরেনা । হাসান এগোতেই থাকে আগুনের গোলার দিকে । গায়ে বিদ্যুৎ খেলে যাওয়া ব্যাপারটা কেরম হয় সেই প্রথমবার বোঝা , শিরদাঁড়ায় শীতল কিছু বইছে কেমন । হাসানের পিছু পিছু এগোতে থাকি । কতখন হেঁটেছি মনে নেই ; আমার মুখ দিয়ে একটাই কথা তখন , চল হাসান ঘর যাই , আর মাছ ধরে কাম নাই । হাসান একসময় বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় ; মাছের ধান্দায় আমি নাই , এইরকম ভুতের খবর আমি অনেকদিন শুনছি , আজ না দেইখ্যা শান্তি নাই । মেলা দিনের খোয়াব এইডা ! আমার মুখে তখনও সেই এক কথা , চল হাসান ঘর যাই । আগুনের গোলার আরও কাছে আসতে হঠাৎ আন্দাজ হল কেউ মাথায় হাঁড়িতে আগুন নিয়ে হাঁটছে , আরও খেয়াল করতে বোঝা গেল , লম্বা চূল , রোগা চেহারার মেয়েমানুষ ; হোগলার বনে লুকিয়ে গোলার আলোয় আরেকটা জিনিস দেখে এইবার পালানোর কথা মনে এলো । কারো যে মুখ দেখা যায়না ! মুখগুলো বিকৃত কারো কান নেই কারো চোখ কেউ যেন গুঁতো মেরে নষ্ট করেছে , কারো নাক গলে ঝুলে পরছে মুখের ওপর , গলায় ঘা , মুখে পিঠে ঘা ! সেই দেখে হাসান মারল দৌড় ,আমিও ঝাপ জলে । ওদিকে আগুনের গোলা বাহকদল তেড়ে গালি দেয়া শুরু করেছে । পাঙ্গা পেড়িয়ে দৌড় আরও । এরম কতক্ষণ দৌড়েছি মনে নেই । একটা গ্রাম আসতেই কুকুরগুলো আরও জোরে চেঁচানো শুরু করল । কে যেন হঠাৎ হাত ধরে মাটিতে শুইয়ে মাথায় জল দেয়া শুরু করেছে , কেউ কুপি নিয়ে মুখ দেখে বলছে বুড়ারবাড়ির পোলা না , পিলকের টারির ছেমড়া যে , এত রাতে কি করে !! হাসানের পাত্তা নেই ! ভোরে তারা বাড়ি পৌঁছে দিল । বাড়ির লোক দেখে অবাক । ঘরের ছেলে কুম্বারি কেমনে গেল ! আমাদের মাছ ধরার গল্প আর কেউ জানেনা । বাড়ির মানুষ ভাবলে ভুতে পেয়েছে , নিশি ডেকে নিয়েছে ছেলেকে । তুকতাক মন্ত্র পড়া চলল সকাল অবধি । কেউ মধু ওঝাকে ডাক দিল , হাবাং হোমিওর ডাক্তার সেই এক ওষুধ খাওয়ালো , জ্বরে যা দেয় কিংবা পেটব্যাথায় । জেঠি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে , এযাত্রায় বাঁচন গেল তোর , রাইতে একেলাই থাকার কাম নাই ! হাসান পরদিন দেখা করল ক্লাসের হাফটাইমে । মুখ ব্যাজার করে বলল এইবারও ভুত দেখা হলনা ! কাসিয়াবারির পাঙ্গার ধারে সেই হোগলার বনে নাকি এলাকার কুষ্ঠরোগীর বাস । তারাই অমাবস্যার দিন কিসের যেন উপাসনা করে মাথায় আগুন নিয়ে উলঙ্গ হয়ে নদী পারাপার করে । হাসান মুখ ভার করে সে গল্প শোনাল । তারপর আর অনেকদিন যাওয়া হয়নি মাছধরতে । 
ভাদ্রমাস পড়ে গেল । হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার সময় । হাসান গোটা স্কুল অবাক করে আরেকটি ওস্তাদি করল । কর্মশিক্ষার ভাইভা সেদিন । কেউ কলমদানি , কেউ পাটের দড়ি , কেউবা মাটির আম , আতা বানিয়ে হাজির । মালিপাড়ার ছেলেদের কাজ বেশি মাটির । শুধু হাসানের হাতে কিছু নেই । কেউ জিজ্ঞেস করলে সে মুচকি হাসে । সহপাঠীরা যে যার মত নিজের নিজের ভারসান বানানো শুরু করেছে ; কেউ বলে হাসান এবার ডাহা ফেল , কেউ বলে হাসান তো ওস্তাদ , কিছু একটা ব্যাপার ঘটাবেই । ভাইভার টিচার নরেন্দ্রবাবু ; সারাবছর তার আমাশার ব্যামো , চরম উত্তেজনাহীন কিছু হলে সেটা নরেন স্যার , নজরুলের কবিতা আর সহায়কে দুর্গার মৃত্যু একরকম নিঃস্পৃহতায় পড়ান । সবাই বলে নেতিয়ে নরেন ! সেই নরেনবাবুর সামনে হাসান ইতিহাস বইয়ে বুকচিতিয়ে লর্ড কার্জনের ছবির মতন দাঁড়িয়ে পকেট থেকে দুটি গোল বস্তু টেবিলের ওপর রাখল । কেউ কিছু বোঝার আগেই দারিমি চিৎকার করে বলল ‘এ যে পেটো !’ । নেতিয়ে নরেন তার জীবনের যাবতীয় জমিয়ে রাখা উত্তেজনা দিয়ে আমাশার কথা ভুলে হাসানকে তাড়া করল । হাসান একছুটে চোখ বড় বড় করে পাঁচিল টপকে সেই যে গেল তো গেলই !
(চলবে)

খিরকিন লোড়চা


এখানে ভরা সময়ের গান নেই আর
মত্ত মানুষের দল হিজিবিজি খেলে কাটাকুটি খেলে ,
দারুন প্রগলভ কোন দিনে
তোমার তোমার মতন উচ্ছাসে , হুল্লোড়ে
খাদকের নমনীয় মাংসপিণ্ডে প্রেমহীন সময়ে 
দয়াপরবশহীন রাষ্ট্রযন্ত্র অঙ্গদর্শন-ভনিতায়
তোমার চোখের ওপর তাকিয়ে ভয় পাবে
এখানে শূন্য শতকের রাত্রিদিন
আবার মহল্লায় মহল্লায় ছেড়ে ছেড়ে যাওয়া
ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়া ক্ষত বিক্ষত আস্বাশ পৃথিবীর বিনীত নরম বালির ওপর একসাথে হাঁটবে - 

কাঁদবে প্রবল শ্লাঘাহীনতায় ;
খিরকিন লোড়চা - কবেকার খিরকিন লোড়চা'রা
ইতিহাস তোমাদের মনে রেখে যাবে ।

সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বিস্যুতবারের গঞ্জ


আমার কাছে আর কোনো গল্প নেই
স্বপ্নময় কোনও রাতদুপুরে শিথান জুড়ে আনাগোনা ভুলে গেছে পদ্যেরা
ঘুম নেমে আসে – ঘুম -  চাঁদপাড়া ভেজা বাওরের দেশে ঘুম নামে
বিচ্ছেদের মত নিস্তব্ধ -
হীনতা -
নীলকণ্ঠ পাখি এক – মৃত
কাফনের সফেদ মায়া ;
তোমায় শুধু ছুঁতে চেয়েছি ।
গৌড়ের চেয়েও প্রবীণতর তরাইয়ে প্রথম মুথোঘাসের জন্মলগ্ন
আরও আদিকাল ধরে হেলেঞ্চার বনে ওম - অনন্ত রাত্তির
যুবতির নিদ্রাহীন চোখ কালিসিটে,
তার গাঢ় নিঃশ্বাসের ভাপ জমে সারাগ্রাম হেলেঞ্চার বনে ;

ভাঙা ভাঙা হাট , ফিরিঙ্গীডাঙ্গা-শালবাড়ি
সমস্ত শহর ছারখার ঘরমুখো পলাত্বকা জনতা আমার বিস্যুতবারের গঞ্জ

দূর দেশ রেলগাড়ি চলে – মশাগ্রাম ,
বারসইয়ের দীর্ঘতম বাঁক ঘুমের ঘোরে কতক্ষণ বহুক্ষণ পেছন পেছন
বেহেশতের শ্রাবণ মাসে আমন ধানের গন্ধভরা অতিবিস্মৃত গাঁয়ে
বয়স্ক প্রেমিকের তোরঙ খোলার মত
গভীর আবেশে জানালায় উঁকি অহরহ,
মহাকাব্য-প্রাচীন একটা শিশু হামাগুড়ি দেয় আলপথে
থমথমে মুখ দীর্ঘ খ্রিষ্টপূর্ব –
অবার্চীন মাঝরাতে মশাল জ্বালিয়ে সমস্ত দিনাজপুর দহলায় রূপচাঁদা খোঁজে ;
মছলন্দপুর ঘাটে নৌকার খোলে মাছের ঘ্রাণ ভরে – স্যাঁতস্যাঁতে – গাঢ় ,
শেষরাতের স্টিমার শহর পাড়ি দেবে তারপর ,
জমে যাওয়া মৃত উজ্জ্বল চোখ, মৃত মাছের নশ্বরতা বেচে
আমার কাছে আর কোনো গল্প নেই জয়ী -
গত শতাব্দী তার আগের শতাব্দী আরও কোন পুরাতন দিনে
চৈত্রের শিমুলতুলো উড়িয়েছি শুধু – ফ্যাকাশে কথাভাষাহীন ।

শুক্রবার, ৩ জুলাই, ২০১৫

যা কিছু বলা যায়


লোহাগড় , কাড়লা, ০৪/০৭/১৫                                                                                                     
                                                                                                                   
    ইন্দ্রায়নী নদীর ধারে কাড়লা এলাকা । বাজা হাট থেকে লোহাগড় পার্বত্য অঞ্চল , বুনো ঝোপের পাদদেশ শুরু । তারপর আরও সর্পিল রাস্তা উৎরাই , কালো আগ্নেয় পাথরের খাঁড়া পাহাড় একপাশে , একপাশে কাঁটাগাছের জঙ্গল রেখে ঘণ্টা দুই হাঁটলে লোহাগড়ের দুর্গ আসে ; দূরে পবন নদী আটকে রাখা বাঁধ দিয়ে ; আরও দূরে প্রায় দেড় কিমি নিচে নিশ্চুপ অরন্যের নিস্তব্ধতা খুন করে পুনে-বম্বে এক্সপ্রেসওয়ের যন্ত্রকলরব । কেল্লার সিঁড়ি বেয়ে মিনিট পঞ্চাশ হাঁটলে ওপরটায় পৌঁছনো যায় ; ওখানে মেঘেরা খেলে বেড়ায় হরদম । ডানে বিসাপুরের দুর্গ, পেছনে পবন নদী , সবুজ ক্ষেত আর লালমাটির কোলাজ আঁকা – ভাগ ভাগ করা জমি বাড়ি অনেক নিচে ফেলে টেবিলের মত সমান কেল্লার মাথা আসে । ইতস্তত বৃষ্টিজমা জলের খাল । পবন উপত্যকার দুরাগত পাখির শব্দ আর মেঘের আনাগোনা ।এইরকম বৃষ্টিজমা জল সমুদ্রপৃষ্ঠের আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায় বড় শীতল , তিরতির করে কাঁপে । সেইখানে বসে লিখতে লিখতে কেমন ঘোর লাগে নেশাগ্রস্থের মত । লিখে এত সুখ আর পেলাম কই ! মাঝে মাঝে পাথরের খাঁজে কামানের ধ্বংসাবশেষ, বক্সারের যুদ্ধে যে কামানের নকশা ইতিহাস বইয়ে থাকে সেরম আকৃতির । যেসব স্থানে জল জমে , ওতে মৌরলার মত ছোট মাছ , কতক লাল রঙের ; জলে হাত , পা ডোবালে সুড়সুড়ি দেয় , দু- আঙ্গুলের এত কাছে আসে যে সহজেই ধরা যায় , এইসব মাছেরা হিংস্র মানবজাতির স্বারূপ দেখেনি হয়ত , যে কারনে আমাদের গাঁয়ে পুকুরের মাছ এরম পাত্তা দেয়না , পাখি এসে ঘাড়ে বসে দোল খায়না ভয়ে অথবা অবিশ্বাসে , সেইরকম বোধ এইসব মাছের এখনো তৈরি হয়নি হয়ত ।  কত শতক আগের এইসব দুর্গ কলরবমুখর ছিল – শিশুর কলতান – গোষ্ঠীবদ্ধ একটা পরিবার ছিল – পশ্চিমঘাটের অনেক উঁচুতে এইমতন কোন জলায় কেউ দল বেধে স্নান করতে আসত – এখন খাঁ খাঁ সব ; রাজার আভিজাত্য – ওপরে আরও ওপরে উঠে কেল্লা বানিয়ে বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে । তারপর একদিন ইতিহাস সব গুঁড়িয়ে দিল । এই শনশন তীব্র হিমেল হাওয়া – ইতস্তত মেঘে যেন শোক – সভ্যতার আদিতে মানুষ আগুন জ্বেলে যে স্পর্ধায় পৃথিবীকে নিজের বলে দাবিদাওয়া দেওয়া শুরু করল সেই স্পর্ধার পরাজয়ের গল্প শুধু এখানে – শতবছরের লড়াইয়ের গন্ধ – জিঘাংসা আর পৌরুষ দিয়ে কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস। পঙ্গু পবন নদী রাজার উত্থান দেখেছে , পতনও । কোনও এমনও দিনে এই মিনারভরা দম্ভের সভ্যতা অস্তাচলে গেলে এই পবন নদী ,এই পাহাড়টা , লোহাগড়ের তীব্র ধুসর শোকস্তব্ধ মেঘ – আবছা লালমাটির ক্ষেতজঙ্গল মিটিমিটি হাসবে – যেন সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে তারা । নিচের উপত্যকায় মৌসুমি মেঘ স্তরে স্তরে এসে জমছে  ; যেদিকটা বসে লিখছি সেদিকে রোদ । ক্রমে গোটা পাদদেশ মেঘে ঢেকে গেল । পাশের মৃদু ঝোড়ায় কেন্দ গাছে চিলের বাসা , দূর দিকচক্রবালে মা-চিল উড়ে এসে ঝপ করে গাছে বসছে । পশ্চাদে বাকিরা এগিয়েছে , কেউ হাঁক দেয় একটা ঢালের ওপার থেকে ।
            বিসাগড়ের কেল্লা যাওয়ার পথে অনেকটা জঙ্গলে মাঝে। সমতল জঙ্গল । অরজুন , জাম , কেন্দ আর কাঁটাগাছের বন । মাঝে মাঝে দোকান আসে । একটা ছাপরার ঘরে দোকান, দোকানির বাড়িও সেটা ; বিছানা , উনুন আর দোকানের পসার মিলিয়ে এক-ছাপরার ঘরে বাস। নিম্বু পানি – কাঁকর – পোহা বিক্রি করে।  যেহেতু এপথে লোক কম ও দোকানের অভ্যুথান-সম্ভাবনা বিরলতর তাই দূরে পায়ের শব্দ অথবা পর্যটকের আভাস পেলে হাঁক দিতে থাকে দোকানদারেরা । সেইরকম একটা দোকানের সামনে এক মহিলার অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থাকা কেমন দুর্বল করে দেয় হঠাৎ ; এইসব পাহারজঙ্গলের বান্ধবহীন বিচ্ছিন্নতা মানুষ সয়ে নেয় কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতার পীড়া সমস্ত চোখজুড়ে ভয়ংকর দৃশ্যমান হতে থাকে ক্রমশ যেন , স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর। অনেক ছোটবেলায় স্কুলফেরত বিকেলে দিদির চোখে , মায়ের চোখে এইরকম ঠিক এইরকম চাহনিই তো দেখেছিলাম । গৃহকাতর নই , যেটুকু রয়ে গেছে তা  শুধু টানমাত্র ; অনেকবছর তো  হল ঘরছাড়া , গৃহকাতরতা আর পীড়া দেয়না তাই। এইসব অজানা দেশে , লোহাগড়ের পার্বত্য অঞ্চলে কেমন যেন হঠাৎ নতুনপাড়ার কথা মনে আসে । লিখতে লিখতে যত ভাবি পুরনো নয় আরও নতুন কিছু চাই এবার , তত বেশি বেশি করে যেন উলটোদিকে হাঁটি , একরকমভাবে , সেইসব স্মৃতিকাতরতা জাপটে ধরে । মানুষ মুক্তি কেমন করে পায় ; তার যাবতীয় একরোখা ফিরে ফিরে তাকানোর পশ্চাদপ্রবণতা থেকে কেমন করে নিস্তার পেতে পারে সে আমার সত্যি জানা নেই । এইসব কেল্লা – রাজাহীন , মালিকানাহীন , জৌলুষ নেই আর কোনও কিছুর , তবুও কেমন মৃত দেয়ালের প্রত্যেক কালো ইটে তার প্রাচীন গল্প শুয়ে আছে উচ্ছল দিনের , উত্থানের আর পতনের – তাদের নিষ্কৃতি নেই , মুক্তির পথও নেই ! পৃথিবী অদ্ভুত বড় ! 

( চলবে ....)



 মাহুলী পশ্চিমঘাট , ০১/০৭/১৫

এইসব জলপ্রপাত , উঁচু খাঁড়া আগ্নেয় পাথরের পাহাড়দেশে , পশ্চিমঘাটের মরশুমী ঝোড়ার ধারে বসে সবকিছু কেমন অদ্ভুত বীরত্বে নাকচ করা যায় । আশমা পারভীন নয় , নয় অনেকগুলো কবিতার অবসাদ । চাওয়া-পাওয়া গুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর যেন । আসানগাঁও থেকে অনেক ভেতরে মাহুলীর এলোমেলো সর্পিল পথরেখা ছাড়িয়ে পথহীন অচিন গাছ , জনহীন ঝোড়ার পাথর পেরিয়ে যেখানে পথ আটকে যায় , শিশুর চোখের মত স্বচ্ছ বিষম সবুজের দেশ , অতীব ব্যাসল্টের পাহাড় সেখানে । কোনো লোভ নেই আর যেন , ক্ষেদ নেই ; নিজেকে চেনা যদি জরুরী হয় তবে এই ডাঁশপোকার জংলি কাঁকরোল-ফুলের দেশে দুরন্ত বিচ্ছিন্নতা স্বাগত ! কি পেলাম , কি বাকি রয়ে গেল তারও অনেক ওপরে তানাসীর রুক্ষ ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়দেশে মেঘের ছায়ামাখা উপলখণ্ডের ওপর শ্যাওলার মত নিজস্বতা চেনা কেমন খুব অবশ্যম্ভাবী মনে হতে থাকে যখন একটা নিশ্তব্ধ বনজুড়ে বৃষ্টি নামে , বোড়া গাছের ঝোপে, বইকালের পাতায় পাতায় একটা গোটা উপত্যকা জুড়ে শুধুই বর্ষণমুখরতা নিরবিচ্ছিন্ন অজানা বন্য পোকার আওয়াজ ; নাহ আর একটাও চেনা মুখ ভাববোনা আর, কোনো  প্রিয় স্মৃতি নেই আমার , প্রিয় কারো জন্য ব্যাকুলতা নেই ; সন্মুখে হাজার শতাব্দীর চেয়েও পুরাতন ব্যাসল্টের পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বলে দেব আর একটুও ভালবাসিনি তোমায় ;  নাগরিক যাবতীয় বেশ খুলে খুলে নিজের খোলস ছাড়িয়ে গভীরতর আরও কারো খোঁজ পাওয়া যায় ; সহজে খুব সহজে । রাঞ্ঝনা ঝোড়ার শব্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে ; আর লেখা যাচ্ছেনা , শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে নির্বাক সময়যাপন এত মধুর ঠেকেনি কখনও । পশ্চিমঘাট , মাহুলীর বনদেশ , ভরান্দের বৃদ্ধ পাহাড়  , অবাঞ্ছিত শ্যেওলার কাছে বড় কৃতজ্ঞ । একটুও বানিয়ে নয় এমন কিছু স্বীকারোক্তি এখানে সহজ বড় , সহজাতবোধের মত । ফেরার পথটা অন্যদিকে কি ; খুঁজে খুঁজে তো অনেক কাল ক্ষান্ত ; ফেলে ফেলে যাওয়া যাসব, মুল্যবান হয়ে থাক তার চেয়ে নাহয় ! 






রবিবার, ২১ জুন, ২০১৫

সেকথা তুমি জানতে ধরো ...


দুপুরের রোদটা নেমে এলেই ভিড় জমে ওঠে এখানে বাসের নিত্যযাত্রীবাদামওয়ালাপাবলিক ওয়াশরুমের লোকজন বাদেও আরও প্রচুর মানুষের ঢের আনাগোনা প্রেমিকযুগল এবং ইতিউতি বেকারআড্ডাপ্রিয় জনতা সংখ্যায় বেশি একটা বাসস্ট্যান্ড জুড়ে এরকম মিলনক্ষেত্র আগে দেখিনি ! বর্ষা ঢুকেছে শহরে সদ্য বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মাস শেষে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কতগুলো বছর কেমন কেটে গেল এখন স্কুলের পরীক্ষার মরশুম শেষ এ’কমাস টিউশান বন্ধ তাই মন্দার বাজার স্টাফ ক্যান্টিনে বাকির চেহারা তিন অঙ্কে তরতর করে বাড়ছে ইস্ক্রা পঞ্চান্ন টাকা , মাশ্রুর দুশো ছল্লিশ , আইডিয়াল মোমো কর্নারে একশ ষাট , তিরুমল গতসেমের দেড়হাজার , কোরক সেকেন্ড ইয়ারের  বারশ  ! আর ভাবা যাচ্ছেনা ! এইবার একটা পার্টটাইম কিছু না-দেখলেই নয় বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা দিনদিন কমছে গ্রেড পয়েন্টের মত মাঝে মাঝে স্বপ্নে পাওনাদারেরা আসে কেউ থারমো’র প্রফেসর হয়ে , কেউ  কেম-রিঅ্যাকশানের প্রফেসর হয়ে কিংবা যে-লোকটা ফাই-কেমের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সে আসে হাতে গ্রেড কার্ড  নিয়ে ; কাজিরাঙ্গার সবচেয়ে ধূর্ত শেয়ালের মত মুখ করে সিএইছচ-থ্রি ফাঁকা রুমে একলা আমার মুখোমুখি বসে বলে হয় ধার মেটাও নাহলে এই-সেমে আরও দুটো সাপ্লি এক্সট্রা ; স্ট্যান্ডার্ড ! তিননাম্বারে বাচ্চার দোকান এড়িয়ে পথচলার মরশুম এটা ; সিগারেটের বাকি এখনো মেটানো হয়নি মেসের প্রত্যেকেই দেউলিয়া চারটে ধার-সন্ধানী প্রাণী একঘরে থাকলে যা হয় ; তাদের সব্বার হাল আমার মতনই আলু সেদ্ধ করে পাঁচফোড়নে ভেজে ওপরে ভাপা সবুজ বরবটি ছড়িয়ে দিব্যিইতালিয়ান খাবার’ নাম দিয়ে সহজেই মুখ বুজে খাওয়া যায় এইবেলা ফাঁকা পকেটে কেমন করে যে চলে অর্ধেক মাস ; কে যে স্পন্সর করে , চারটে ব্যাঙ্করাপ্ট বুঝে ওঠেনা কখনই ; তবে জালিইতালিয়ান’ , ‘ফ্রেঞ্চ’ , ‘মাদাগাস্কারের’ ডিশ নাম করে তিনটাকার বাটার দেয়া কল্মি সেদ্ধ , পেঁপের স্টু , মুলোর সালাদ অথবা পটলের সুড়সুড়ি ভাজায় হাফ পাউন্ড এক পাউন্ড রুটি বেশ চলে যায় ! তারপর মাস শুরু হলে অথেন্তিক বাঙালি খানাপিনা চলে আর ধার মেটানো সাথে গোটা মাসের গল্পটা শেষ তিনবছরের মত যেন তিরুমলের , মাশ্রুর , কিস্কু , তাতাইয়ের কিছু ওড়ার গল্প খেলার মাঠ , সিঈটি , আশীর্বাদ আর ঝিলের ধার ; আরও কতক দেয়ালে , অনেকগুলো বন্ধু মিলে রাতজাগা অনেকগুলো রাত্তিরের হলুদ আলোর এক দুই তিন চারে , সিএল মোড়ে চলন্তিকায় ; গল্প লিখে শেষ করা যায়না এমন সব গল্পে ; খুবতারও বেশি দ্রুত ,তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়া সময়ের সাথে সাথে    সেদিন মিছিলে আরেকটা মুখ ; পুরাতন জামা , জিন্সের ইতিহাসের চেয়েও প্রাগৈতিহাসিক রঙহীন প্যান্ট পড়া যুবক গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে , পৃথিবীর আর সমস্ত পাওয়া না-পাওয়ার কথা ভুলে স্লোগান ওঠালে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে ! এসসি মল্লিক রোডের মাঝে ভনিতা করে টাঙ্গানো লাল পতাকার সারি , লেলিনের মূর্তিকারো কিসসু আসে যায়না বিপ্লব’দা ; বিপ্লব’দার অনুবাদ, তার লেখায় অনেকটা ইউরোপলাতিন আমেরিকা ঘোরা হয়ে যায়আরও কত নিজের চেনা-অচেনা গলিঘুপচি মুক্তমানুষ কম দেখেছি ; যদি সত্যিকারের মাথাউঁচু করে বাঁচা , দাসত্ব না করে বাঁচা বড় স্পর্ধা হয় , আমি সেই মিছিলের মুখ আর পৃথিবীর বিপ্লব নায়ক হতে চাই ! অঙ্গন প্যারিসে , ঘন্টু ম্যানেজার হয়ে যাবে , আর যারা স্টার্ট আপের প্ল্যান বুনছে তারাও অনেকদুরসমুদ্দুরপাড় আইডিয়াল মোমো কর্নারের মালিক , তারপর ওপারে তেলেভাজার দোকানি , নচিকেতা টি-স্টলের দাদা , ধোসার দোকানের মহিলা , মশলামুড়ির দোকানদার , কাঠের কারিগরবড় সড়কের চায়ের দোকান , তেলেভাজার ভিড়ের রেগুলার লোকেরা প্রত্যেকে যারা এক একটা মৃত স্বপ্নের জীবাশ্ম বয়ে চলছে ; যাদের কিছু চাওয়া আছে , না-পাওয়া তারও ঢের বেশি অথচ তারা সুন্দর হাসতে জানে , কাঁদতেও ; পৃথিবীর গাঢ়তম অন্ধকারের সন্ধ্যেয় তারাই দুধারে ফুটপাথ আলোকিত করে রোজ মরে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠে ; একটা মৃত্যুর বীজ থেকে আরেকটা দোকানি , আরেকটা মুটেমজুর, আরেকটা কর্মহীন বেকার বৃদ্ধ- মাঝবয়স্ক ঘুম ভেঙ্গে আবার বেঁচে ওঠেদুর্বার আকাঙ্ক্ষায় ! শনিবারে দু’নাম্বার গেট বন্ধ হওয়ার আগেই সিএল চলন্তিকা , ব্লু-আরথের সামনের কৃষ্ণচূড়ার আভিন্যু পাড় করে সিইটি ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠবো আসমা পারভীন , তাকে পাঠানো আরেকটা নিরুত্তর মেসেজের জন্য অপেক্ষা করবনা একটুও ; “ গন্তব্য আমি জানিনা আমার , তুমি জাননা আমারও ; তুমি, যাকে ভালবাসা যেতে পারতো , সেকথা তুমি জানতে ধরো ...

ছুটতে ছুটতে কোনওমতে শেষ উত্তরগামী ট্রেনে চেপে ঘরমুখো হব ; আর কক্ষনো ফিরবনা জেনে এইখানে জুলাই মাসের সন্ধ্যেবেলা আশুরগড়ের ঝিলে ব্যাং ডাকবে ; আমি কাদার রাস্তা ভাঙতে ভাঙতে শামিলারবসতের ধঞ্চেগাছের ক্ষেত পেরবো , আমন ধানের জলে শ্যাওলার গন্ধ নাকে আসবে বরশাতি বুনো মাধবিলতার ঘ্রাণে বিতলটারির আমবাগানে কালো অন্ধকারে নীল জোনাকির জঙ্গল ঠেলে ঘরে ফিরব সেদিন রাঙ্গাপিসি জিজ্ঞেস করবেনা চাকরি পেলুম কিনা বাবা মার্কসীট দেখতে চাইবেনা ; মা তার দোতলা বাড়ির স্বপ্ন ভুলে যাবে পাটপচা পুকুরের গন্ধ সুমধুর হবে বিটলটারির আকাশে সেদিন সুন্দর কালপুরুষ ; তার চেয়েও সুন্দরতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকবে !     


-    সেইসব বন্ধুদের , যাদের ছাড়া কলকাতা জনহীন মনে হয় ।