শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৬

হাকিমতপুর ডাঙ্গার গল্প

হাকিমতপুর ডাঙ্গার গল্প



শহর যাইবা না , শহর ?
ঝড় আইলো আইলো করে যে , দেখোনা ওই পস্ছিমদিক কেমন  ম্যাঘ কালো হইয়া আসে।
বিকালভর গাঙ্গের জলে পা-ডুবাইয়া বইসা থাকো এইসময় ; পাটখ্যাতের মাথার উপর কালা ফিঙ্গা উড়ে আর বসে ; ঢিলাঢালা লুঙ্গিপরা হাবুলের পোলা নয়াচরের ঘাসবোঝাই ডিঙ্গা নিয়া ফেরে , দূর থ্য়িকা হাঁক দেয় একটা।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

মাখমুদ স্ট্রীটের নিখোঁজ বাড়ি এবং একটি মিথ্যে গল্প


"So enter our houses, conquerors, and drink the wine 
of our mellifluous Mouwashah. ...
Our tea is green and hot; drink it. Our pistachios are fresh; eat them. 
The beds are of green cedar, fall on them, 
following this long siege, lie down on the feathers of 
our dreams. The sheets are crisp, perfumes are ready by the door, and there are plenty of mirrors: 
enter them so we may exit completely. Soon we will search 
in the margins of your history, in distant countries, 
for what was once our history. And in the end we will ask ourselves: 
Was Andalusia here or there? On the land ... or in the poem?" -  Mahmoud Darwish




ভরদুপুরে হেব্রনের চারনম্বর চেকপয়েন্ট একটু বেশি ভিড়ে ভর্তি। সেদিন কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি , ঢিল ছুঁড়ে চড়াও হয়নি জলপাইরঙের কনভয়গুলোর ওপর বরং সেই ভীড় অনেক বিনয়ী ছিল।  চেকপয়েন্ট দিয়ে একটা প্রিজন ভ্যান ঢুকতেই সমবেত ভীড় উল্লাসে ফেটে পড়ল , কোরাসে হাততালি আর সুর করে স্লোগান , আকাশের দিকে কিছু পতাকা তিরতির করে কাঁপছে যেমনটি খুব কম ওড়ে ; করতালি বাড়তেই থাকে, যেন শেষ শক্তি অবধি এই স্লোগানের কোরাস চলবেই  ... আসসালাম , আসসালাম, য়ায়ে শাহিদো আস্সালাম - স্লোগান আরো বাড়তেই থাকে , ভীড়ের প্রত্যেকে ছন্দবদ্ধ মাথা নাড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে প্রিজনভ্যানের দিকে তাকিয়ে ; ইতিমধ্যে যার অপেক্ষা সেই নায়েল বার্ঘুতি দীর্ঘ তেত্রিশ বছরের কারাবাস শেষে অচেনা অথচ প্রিয় মুখগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ; কেউ এসে তার গায়ে আরেকটা পতাকা জড়িয়ে দিল ; 'যে মায়েরা সন্তান হারিয়েছে , যে শিশু বাবা আর যে ভায়েরা তাদের স্বজন' হারিয়েছে , গভীর আত্মীয়তায় তারা বার্ঘুতিকে জড়িয়ে ধরল , চুমু খেল দু'গাল ভরে ; অতঃপর সেই ভীড় বড়সড়ক ধরে হেব্রনের আরেকটা 'নামহীন কলোনির' দিকে মিশে গেল। 


রামাল্লাহার চৌমাথার মোড়ে অধুনা যে সুপারমার্কেট তার ঠিক পেছনেই মাইলের পর মাইল ঘিঞ্জি বসতি দীর্ঘ বছরের বোমাবর্ষণ আর যুদ্ধ তারপর আরো গড়ে ওঠা আবার ধ্বংস অগনিত মৃত্যু - সান্ত্বনা - বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খা, যারা রোজ মরে গিয়ে আবার খাবি খেয়ে ওঠে একাধিক দুঃস্বপ্নের পর ঘামে ভেজা ঘাড় আর চুলের সংস্পর্শে সেইসব পুননির্মাণের দাগ গায়ে নিয়ে আছে । বার্ঘুতি ভালই জানে তার চেনা স্বজনদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল দীর্ঘ তিনদশক পর এইখানে গিজগিজ করা শহরটায় ।  মাখমুদ স্ট্রীটে লেভেন্তীয় স্থাপত্যের ধ্বংসপ্রায় যে বড় কম্যুনিটি হাউসিং তারই তিনতলায় একটি থাকার আস্তানা পেল কোনমতে। এ রামাল্লাহার ভীড় যেন তার যৌবনের যুদ্ধবিধ্বস্ত আল-কারামেহ মনে করায় ; মনে করায় সেই কবেকার 'ছ'দিনের যুদ্ধ' কেমন করে তাদের ছ'দশকের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো ; রোজকার এই লড়ে লড়ে মরে বেঁচে ওঠা , জেলবন্দী গত তেত্রিশ বছরে প্রত্যেকটা দিনের যুদ্ধ আজকের রামাল্লাহার গলিতে গলিতে নেমে এসেছে যেন , প্রত্যেকের মুখ থমথমে , রাগ আর ভয়ে ; সে ভয় মৃত্যুর নয় , হারের নয় ; যে গণিকার মুখ খদ্দের সবচেয়ে ঘেন্না করে অথচ যাকে ছেড়ে যেতে পারেনা , আফিঙের নেশার মতন গতরের ভেতর থেকে আরেকটা খদ্দেরের গতর বের করে টেনে হেঁচড়ে আনে তারপর ছিঁড়ে খায় আর সেইসব অর্ধশতাব্দীর আঁচড়ের চিহ্ন গণিকার শিশুবেলা যেমন করে ভুলিয়ে দেবে , ভুলিয়ে দেবে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি , পৃথিবীর সুন্দরতম আঙ্গুরক্ষেতে উত্তর হেব্রণ অথবা নাবলুসে অথবা অন্য কোথাও প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে নিষ্পাপ শিশুদের সমস্ত পুরনো কথাগুলো ঠিক সেইভাবে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়ার ভয় , সেইভাবে নাকচ হওয়ার ভয়ে প্রত্যেকের মুখ থমথমে হয়ে থাকে ! খাঁ খাঁ পাথরমাটির উঁচু নীচু ঢেউ খেলানো পাহাড়ে ঢিবিগুলোর শেষে যেখানে ছোট ছোট গ্রামে অলিভ খামার শুরু , সেইসব খামার আর আগের মত নির্জনতায় ঝিমোয় না বরং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আরেকটা বোমাবর্ষণের ভয়ে সজাগ হয়ে থাকে দিনভর ।  সন্ধে হলে সেটলারদের শহর মদীন-মাক্কাবিম-রেউত এর উজ্জ্বল আলো রামাল্লাহকে আরো কেমন নিরুত্তাপ স্যাতস্যাতে করে দেয় , মৃত্যুর চেয়েও শীতলতম , ডুঁকড়ে ওঠা কান্নার পর যে  ভয়ার্ত নিস্তব্ধতা পেয়ে বসে সেরম ধুঁয়া ধুঁয়া মনে হয় দুনিয়াটা ।  এ রামাল্লাহ তার চেনা কিন্তু আবার ঠিক কেমন চেনা নয় ! সন্ধের পর বার্ঘুতি পথে নেমে আসে কেমন নিজের অজান্তেই , অচেনা গলি পথ ধরে আনমনে এগোতে থাকে , এগোতেই থাকে ; ঘিঞ্জি বসতি পার হয় , ভাঙ্গা দালান , খুলি উড়ে যাওয়া , হাপর দুমড়ে যাওয়া বিল্ডিঙ্গের কবর পার হয় ; তারপর আরো সরু গলি আসে দমবন্ধ ; দমবন্ধ হয়ে আসা ক্রমশঃ সরু হতে থাকা কাফের-গলির ভেতর হাঁটে ; দুদিকের বাড়িঘরে  মানুষ জন তেমন চোখে পরেনা; বিচ্ছিন্ন টেলিভিশনের শব্দ আসে জর্ডানিয়ান অথবা লেবানীজ চ্যানেলের , হেঁশেলের ভাজার আওয়াজ  , শিশুদের অস্থির কান্না , কারো ঘরে চকিতে বাসন পরার দূরাগত শব্দ একসাথে তালগোল পাকিয়ে বার্ঘুতির আলাজিব্হার কাছে জমে জমে টুটি চিপে ধরতে চায় , এরম দিশাহীন দুদন্ড হাঁটতেই একটা ভীড়ময় বড় রাস্তা আসে ; সে তাকিয়ে থাকে হতভম্বের মত ; মাখমুদ স্ট্রিট কোনদিকে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে ; খনিক ভীড় বুলিয়ে নিতে চায় চোখে , আহ্লাদে কতদিন মানুষের ভীড় দেখেনি সে ; আহা ! একরাস্তা গমগম করা ভীড় তার কত প্রিয়, আজন্ম ; সেই কবেকার যেন, যেদিন রোমানরা এলো , তারপর এই সেদিন তুর্কিরা তারপর ফিরিঙ্গি, হুম সেই ফিরিঙ্গিরা যেদিন এলো , ইহুদিরা , সেই , সেই প্রত্যেকটা দশকে বার্ঘুতি একসাথে চলতে থাকা গমগমে ভীড়ের রামাল্লাহ দেখতে চেয়েছে সত্যিই ! দ্রুত ঘোর কাটলেই সে আবার জাবালিয়া মাখমুদ স্ট্রিটের  ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে রামাল্লাহার ফলওয়ালা , হামাসের দোকানি , মুসাখাঁ রুটির তলবদার প্রত্যেককে ধরে ধরে জানতে চায় মাখমুদ স্ট্রীটের রাস্তা , সবাই হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে ; নিজের কাজ করতে থাকে ; কেউ উত্তর দেয়না ! বার্ঘুতি আরো চওড়া রাস্তার দিকে এগোতে থাকে আনমনে , অদ্ভুত ঘোরগ্রস্থের মত।  সেন্ট্রাল রামাল্লাহার টিমটিমে হলুদ আলোর যে চা-খানা গুলো জেগে থাকে তার একটায় ঢোকে।  হঠাত অচেনা লোক , পেহচানহীন স্বদেশীকে দেখলে লোকেরা যেমনটি চেনার চেষ্টা করে , গোটা চা-খানা একসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে বার্ঘুতি কে দেখতে থাকে এবং খুব দ্রুত উত্সাহ হারায় অতঃপর। সে চা-এর জন্যে আসেনি।  ঠিকানা খোঁজাটা জরুরী বটে।  তবে বহুদিন জেলবন্দী মানুষেরা যেমনভাবে লোকসমাগম দেখে বিনোদন পায় ; উদ্দেশ্যহীনভাবে , লোকের একত্র গল্পগুজবের গুঞ্জনে যেমন নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে , বার্ঘুতি ঠিক সেইটে করতেই এসছে হয়ত ; কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ ইতিউতি চেয়ে হঠাত্ আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করে বসল , জাবালিয়ার মাখমুদ স্ট্রিট  ....? টেবিলের উল্টোদিকের লোকটা তার দিকে বার্ঘুতির মুখে না তাকিয়ে , পেয়ালায় চামচ নাড়াতে নাড়াতে উত্তরে জানালো সেও এক ঠিকানা খুঁজছে বহুকাল , ও-ঠিকানার হদিস কেউ দিতে পারেনি, নাহ  সারাশহরে কেউ নাহ ! 

হতাশ বার্ঘুতি আবার পথে নামল বিধ্বস্ত , কপালে ঘাম জমছে , আর কাউকে জিগ্গেস করার সাহস হয়নি তার , পাছে কেউ সেই ঠিকানার অনিশ্চয়তা সপাটে জাহির করে দেয় , সেই ভয়ে।  সে হাঁটতেই থাকে , বাঁধানো সড়ক পার হয় , নিরুত্তাপ এগিয়ে চলে , প্রলাপ বকতে থাকে , বিড়বিড় করে নিজের সাথে ; তেমাথা চৌমাথার মোড়ে আলেপ্পোর গোলমরিচ ছড়ানো হালাবী কাবাবের গন্ধ নিবিড় হয়ে নাকে এলে সে গলা চড়িয়ে গাল দেয় , চিত্কার করে বলে কাবাবের খুশবুতে দেখো কেমন মানুষের খুনের গন্ধ ভরে , চোখ বড় বড় করে  চারদিকে জোরে শ্বাস নিতে থাকে আর বিড়বিড় করে , ফিশফিশিয়ে বলে - গানপাউডারের ঝাঁঝাঁলো ঘ্রাণের গল্প শোনায় নিজেকে ; ক্রমশঃ নুড়ির পথ আসে , শহরের আলো পেছনে আরো পেছনে যেতে যেতে মিলিয়ে যায় , বার্ঘুতি তখনও চলতে থাকে। 



"O land of ours ...
remember us now, wandering
among the thorns of the deserts
wandering in rocky mountains,
remember us now,
in tumultuous cities across the deserts
and oceans.
Remember us with our eyes full of a dust
that never clears in our ceaseless wanderings. "Jabra Ibrahim Jabra


দারউইশ যেমনভাবে হাঁটত রামাল্লাহায় , তেমনটি আরো সহস্র হাজার নির্বাসিতের দল হাঁটতে আসে হেব্রণ , জাফ্ফা , রম্মতগন , রামাল্লাহা , নাবলুসের জনহীন পথে মাঝরাতে ; কোনো নির্জন অলিভ গাছের অন্ধকারে সেইসব নির্বাসিত ছায়ারা ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীন ; সদ্য কুঁড়িফোটা সায়ট্রাসের বাগানে এসে কেউ থমকে দাঁড়িয়ে মাটি নেয় মুঠোভর্তি , তারপর গায়ে-মুখে মাখে  উন্মাদের মত কিছু খোঁজে ; নতুন অলিভ ফল হাতে ছুঁয়ে আবার যে  যেপথে এসেছে সেইপথে মিলিয়ে যায় , হারিয়ে যায় , তাদের কথা কেউ জানেনা , খোঁজও কেউ নেয়না। তবে কেউ কেউ ওই নির্বাসিত ছায়াদের দেখতে পায় বটে। সেইরাত্তিরে বার্ঘুতি প্যালেস্টাইনের সব নির্বাসিত ছায়াদের সাথে হাঁটছিল , মাখমুদ স্ট্রিট খুঁজতে।  সে আর কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেনা , রাস্তার নাম জানতে চায়না ; মাখমুদ স্ট্রিট দূর গাজা জাবালিয়ায় হতে পারে বা রামাল্লাহায় - সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয় , খোঁজটাই কেমন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় ; হাঁটতে হাঁটতে ভোর রাতে নাবলুসের কাছাকাছি কোনো অলিভ খামারের ধারে জিরিয়ে নেয় , ঝিমোয় ক্লান্তিতে ; অতল ঘুমের ভেতর থেকে সাইপ্রাস হয়ে ঘুরে আসা ভূমধ্যসাগরের ঢেউ গাজার সমুদ্র সৈকতে যেরম উচ্ছলতায় আছড়ে পরে তার শব্দ পায়  ; পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর শঙ্খচিল জাবালিয়ার তটে উড়ে বেড়ায় ; বার্ঘুতির শৈশবের দিনের কথা মনে আসবে , তাদের সাইট্রাস বাগানে  আরেকটা বোমা পরলে পোড়া সায়ট্রাসের পাতা চর্-চর্ করে ফাটবে গভীর বেদনায় ; নিজেকে মিথ্যে সান্তনা দেবে আবার , মাখমুদ স্ট্রীটের সেই ঠিকানা ভুলে যাওয়ার ভান করবে , সেই বাড়িটা , গত তেত্রিশ বছর , তার আগের একুশ বছর নির্বাসিত ছায়াদের মত যে বাড়িটা খুঁজছে , সেটা রামাল্লাহায় হতে পারে কিংবা জেরিকোতে , নাবলুসে হতে পারে ; তেলাভিভ অথবা  জাফ্ফায় হতে পারে ; জাবালিয়ার তটে সাইট্রাসগাছ ছাওয়া সেই বাড়িটা যার তলায় মৃত প্যালেস্তিনীয়দের গণকবর লুকোনো আছে আর আছে কান্না , জেলবন্দী নাঈল বার্ঘুতি সেটা ভুলে যেতে চাইবে প্রবলভাবে 

"I am Adam of the two Edens, I who lost paradise twice. 
So expel me slowly, 
and kill me slowly, 
under my olive tree"


- প্যালেস্টাইনের সবকটা নাঈল বার্ঘুতি'কে আর তার নির্বাসিত প্রত্যেক দেশবাসীকে 

সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬

মায়াকভস্কি তোমাকে

 



মরে যাওয়া নদীটার ধারে পশ্চিম দিকের আকাশে তাকিয়ে বুড়ো  খিরকীন লোরচা ভেবেছিল এবার থেকে ভালো মানুষ হয়ে যাবে।  উছল গাঙ্গে আশ্বিন মাসে কেমন বেমানান চরা দেখে তার নিজের মাথার চুল মনে হয় , কেমন পুরনো শুকনো , দুই কোমর-তিন কোমর বালি খুঁড়লেও জল পাওয়া যাবেনা যেন।
সরস মাটির মতন মনে হয়না ;
অবশেষ-চুলের ভিতর বিলি কাঁটলে নিজেকে জীয়ন্ত মানুষ মনে হয়না । 
লাশিন পশ্চিম দেশে বেপাত্তা হওয়ার পর কত বছর এরকম তাকিয়ে থাকত বুড়ো , দূরে গরম বালির ওপর , ঝাউগাছের জঙ্গলের ওপার থেকে ভরদুপুরের কোনো কম্পমান কালো ছায়া  দিগন্ত ধরে এগিয়ে এলে লোরচার চোখ জ্বলজ্বল করে , বুক ভরাট হয়ে ওঠে , একটা অদ্ভুত দলা পাকিয়ে ওঠে গলা বেয়ে আশায়। লাশিন ফেরেনি কোনদিনই  ; অভ্যাসের বশে রোজ মাঝবেলা  উত্তেজনা নিয়ে নদীর ধারে এসে বসে সে , বোবা হয়ে থাকে , ইতিউতি খোঁজে অথবা খোঁজার ভান করে সারাবছর , হাওয়ার সাথে বিলাপ করতে করতে  মরশুমি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে কোথায় যে হারিয়ে যায় ! অতঃপর বিকেল হলে তার ঘোর ভাঙ্গে খানিক। 
মল্লারপুর , পরামানিকের চরে শন কাটার মাসে অচেনা মানুষেরা ভীড় করে , সারাবছর উদ্বাস্তু হয়ে ঘোরা লোকেরা চালাঘর বানায় তখন, বালির উঠোনে সংসার পাতে বর্ষা না আসা পর্যন্ত  , চরুয়ারা রাতে আগুন দিয়ে শনের জঙ্গল পুড়িয়ে ক্ষেত করে, মল্লারপুরের শেষ সীমানা অনেক রাত অবধি লাল হয়ে থাকে সেই আগুনের রেখা বরাবর ; দিনের বেলা চকচকে কালো পিঠের বাচ্চারা হাঁটুজলের নদীর ওপর আহ্লাদি মৌরলার ঝাঁকের ছন্দে ছোটাছুটি করলে, কারো কারো মুখের গড়ন লাশিনের মুখ মনে করে কতবার তাকে খুঁজতে গিয়ে আবার হারিয়ে ফেলে বুড়ো , নাওয়া খাওয়া মাথায় ওঠে লোরচার তখন !
বুড়ো খিরকিনের ঝিমোনো রোগ যেবার হলো , তারপরের বচ্ছর তাকে পেল আরেক রোগে।  পরামানিকের চরা উত্তরে আরো চারমাইল লম্বা হল সেই শুখার সনে , দূর দূর গায়ের আরো কিছু লোক পাকাপাকি থান বসালো যার যার ; মহাল দাগালো থলকলমির বেড়া দিয়ে ; কোন আভাগা চাষা একদিন ভুলেই টাকা চেয়ে বসল ধারে তার কাছে  ; বুড়ো খিরকিন মানুষের এমন রূপ তো দেখে নাই আর কখনো , বাপ্ রে বাপ ! কি তার চোখের জেল্লা , মনে হয় এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে খুলির ভেতর থেকে ! ধারের টাকা পাওয়া সেই চাষার খুশির চেয়ে , লোরচার ঢের বেশি আকর্ষণ ছিল ও ব্যাটার লোভাতুর চোখ দুটোয় ; তারই মতন  শীর্ণ , নিষ্প্রভ আর মৃতপ্রায় আরেকটা মানুষ কেমন খোলস খুলে খুলে ধারের গল্প ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে বলতে কলিজার ভেতরের গোটা আরেকটা শয়তানের ফন্দিভরা মানুষকে আলতো করে এনে দাড় করালো খিরকিনের উঠোনে তারই সামনে আরেকটা নতুন গল্প শোনাতে ; সে মানুষ যেমন চতুর তেমন মিচকা সয়তানের মতন নিরাকার , তাকে যেদিকে ঘোরাও সেদিক ঘুরবে , যা মানাতে চাও তাই মেনে নেবে , তোমার কিসে কিসে  আপত্তি হতে পারে সেইসব আগাম আন্দাজ করে সেইমতন তোমার হাতের ওপর গড়াগড়ি খাবে , তখন তুমি তাকে কাতুকুতু দিতে পার , টোকা দিয়ে অস্বস্তিতে ভরাতে পার হামেশাই , থেঁতলে দুই হাতের তালুর মধ্যে দমবন্ধ করে মারতে পার অবধি অথবা কান মলে দিয়ে আকাশের দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে বলতে পার , দূর দূর অবধি ছায়া খুঁজতে বলতে পার দীর্ঘ ছত্রিশ বছর যেমন খিরকিন নিজে খুঁজেছে হারিয়ে যাওয়া লাশিনের ছায়া , নিজের মৃত স্বজনদের ছায়া দীর্ঘ ক্লান্তিকর শতক  ধরে , সে তাই করবে মুখ বুজে ; একটাও শব্দ করবেনা অভিযোগের !
সেই থেকে মল্লারপুরে রটে গেল খিরকিনের কথা , ধার দেয়ার লোক বুড়ো খিরকিন লাশিনের ছায়া খোঁজা ছেড়ে ,নদীর ধার ছেড়ে ধার-খোঁজা মানুষের ভেতর আরেক যে শয়তানের দেহ বসত করে , সুন্দর - সহজাত সয়তানের দেহ , তাদের গল্প শোনে সে এখন , পেয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতন করে লোক ছাড়ায় , ভেতরের ধান্দাবাজ সহজাত মিচকা শয়তানের ডেরা সেইটার সন্ধান করে বেড়ায় ।
কয় বিঘা জমিজমা আর কয়েকভরি যৌতূকি মাকরির মালিক খিরকিনের আসল কয়েকমাসেই ফুরিয়ে গেল।  আরো
বছরখান কাটল তার সেই পুরান ছায়া খুঁজে ; জৈষ্ঠ্য মাসে ভাটিপ্রহরে গরম জলের ওপর হাসফাস করা রঙিলি বরোলির ঝাঁক ঢেমড়ে সাঁতার কেটে বেড়ালে, নিজেকে সেরকম উদ্দ্যেশ্যহীন মনে হয় তখন তার , মনে হয় সে কখনো লাশিনের ছায়া সত্যি খোঁজেনি পশ্চিম দিকের আকাশে তাকিয়ে , খুঁজেছে অন্য কিছু !
মল্লারপুর , পরামানিকের চরায় সন্ধ্যেবেলা ধানভাঙ্গা কলের আওয়াজ পাওয়া যায় ; ঢেঁকির মিস্তিরিরা মহাল ছেড়েছে কবে কেউ জানেনা , ঐদিকে ট্রানজিস্টরের শব্দ , অধুনা আমদানি সাইকেলের বিচ্ছিন্ন সান্ধ্য বেলবাজি কাঁচা সড়কটাকে মাতোয়ারা করে রেখেছে ; সেরকম এক সন্ধ্যেয় সর্বস্বান্ত খিরকিন লোরচা পরামানিকের চর ছাড়ল , ওই মেখলিগঞ্জের কালো আকাশটার উল্টোদিকে , পশ্চিমে , যেদিক থেকে লাশিনের ঘরে ফেরার কথা ছিল , সেই পশ্চিমের আকাশের তলায় বসতির টিমটিমে আলো নিশানা করে হাঁটা লাগলো মন্দলঘাট রেলগুমটির দিকে ! দিনের শেষ ট্রেনটা কালো ধোয়া উড়িয়ে ছুটে যাবে শহরের দিকে কিংবা অন্য কোথাও।  হালকা বিজলীর আলোয় দিব্যি বোঝা যাবে একেকটা মানুষের অনেক অনেক ছায়া , প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম গভীরতায় বৃহৎ আরো বৃহত্তর ছায়া কেমন হারিয়ে যায় , কেমন একটা আরেকটাকে গভীর স্নেহে গ্রাস করে , খাদকের অপরিসীম সৃজনশীলতায় অধুনা নাগরিকের দল কেমন মেতে ওঠে পশ্চিমগামী রেলগাড়িতে ।  যদিও ইস্পাতের দুটো লাইন রেলপথের কোথায় মিলেছে কেউ জানেনা ; আপাত মিলন যে সামনেই কোথাও , তা যে-কেউ দেখে বলে দিতে পারে কিন্তু ওই রেলগাড়ি যতোই এগোয় , লাইনদ্বয়ের সন্ধি তত এগিয়ে চলে আর ছায়ারা ছুটে চলে দিবারাত্র , সীমাহীন আগ্রাসী যাত্রায় ! খিরকিন লোরচা তাদের সাথেই যোগ দেবে !