রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬

গৃহযুদ্ধের শেষ সৈনিক


রাস্তাটা কিশোরগঞ্জ ছাড়িয়ে ভবেশের ডাঙ্গা পার হয়েছে বা ভবেশেরডাঙ্গা অতিক্রম করে ইসমাইলের হাট পার হল হয়ত শেষ সন্ধ্যেয়। কিছু বোঝার উপায় নেই । চেনা শব্দগুলো লোপ পেয়েছে গৃহযুদ্ধের দৌরাত্মে আর বিভীষিকায় ।এই সময়ে শুধুই শব্দের পেছন ছুটলে রাস্তা ধরে চলা মুশকিল , মাঝে মাঝে মনে হয় কিশোরগঞ্জের শিরিষঝাড়ের জঙ্গল গতরাতে অতিক্রান্ত হয়েছে , কখনও মনে হয় এইতো সেই চেনা গন্ধটা বুঝি নাক ছুঁয়ে গেল , অতঃপর ফের গভীর নিঃশ্বাসে তাকে পাওয়া যায়না আর ; পচাপাতার গন্ধ - অনভ্যাসের জনহীন হাটবাজার – চেনা অথচ শূন্য কাঁচাসড়কের থেকে উঠে আসা জন্মের ওপাড়ের কোন অপরিচিত গন্ধ আর শব্দেরা প্রবলতরভাবে ভিড় করে আসে , সেই শেষবার যখন এপথে ফিরছিল ;চেনা-অচেনা মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন জীবন , হাটের উষ্ণ সমাগম , মালবাহী গাড়ির সারি , রাস্তা খুঁজে নেয়া সহজতর অনেক সহজতর ছিল পৃথিবীতে , সবচেয়ে সুন্দর শরৎকালের বিকেলে এমন বিষণ্ণতা তার অভিজ্ঞতায় আগে কখনও ছিলনা ; একসময় যেসব বুনো ঝোপঝাড়ের গন্ধ নাকের ডগায় এসে সুরসুরি দিত আর পথ বাতলে দিত অন্ধ ইদ্রিস আলির , হাজার হাজার গ্রামের আতঙ্কিত আশাবাদী জনতার সাথে সাথে যেন গঞ্জের যাবতীয় নিজস্ব ঘ্রান বেপাত্তা হয়েছে ।ফলত, রাস্তা ধরে চলা বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ; অনেক দূরে সদরঘাটের দিকে অবিরাম , অলস গতিতে চলতে থাকা সমস্ত সড়ক তার স্মৃতির সেই পুরনো সড়ক নেই আর ; ঘরছেড়ে পালানো প্রত্যেক জনতার এক একটা বেঁচে থাকা দিনের মতন অনিশ্চয়তা আর কৌতূহলে ভর্তি তার সামনের সদরঘাটগামী রাস্তা ; মৃতপ্রায় রুগিদের বেঁচে ফেরার মতন সবচেয়ে অন্ধকারময় আশাবাদী এর নেশা ; মৃত্যুর চেয়ে ঢের শীতল আর নৈঃশব্দ্যভরা এর অপার্থিব শব্দরাশি , ক্রমাগত প্রবল হতে থাকা ঝিঁঝিঁর আওয়াজ , জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ঘোর লাগিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট , হতভম্ব করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট । দুদিন পেটে কিছু পড়েনি , যাবতীয় অর্ধচেনা , সম্পূর্ণ অচেনা যুদ্ধবিদ্ধস্ত পৃথিবীর শেষ উদ্বাস্তু যেন নেশাগ্রস্থের মতন পথ ছলছে তো চলছেই ; ইদ্রিসের ঘোর ভাঙল একটা শব্দে, তার যে পুরনো লাঠিটা আজন্ম সঙ্গ দিয়ে এসেছে পথ বাতলে দিয়ে , সদরঘাট সড়কের ওপর সেটা গিয়ে টোকা মাড়ল একটা কাগজের বাক্সে , হাতে ছুঁয়ে দেখে অচেনা গড়নের খাপ , ভেজা তামাকের গন্ধটা প্রকট হয়ে উঠতেই বোঝা গেল সেটা সিগারেটের বাক্স ,বর্জিত গায়ের বস্তু এ নয় , খাপের ওপরটা পেলব আর শহুরে মসৃণ , ঝাকিয়ে নিতেই ভেতরে কিছুর আন্দাজ হতেই ইদ্রিস আলি সিগারেটের উপস্থিতি ভেবে তার ঝোলায় দেশলাই খোঁজা আরম্ভ করে দেয় , বুকপকেট , ফাটা প্যান্টের যাবতীয় পকেট হাতড়াতে থাকে , নারায়নগঞ্জের সেরা জিলিপি ময়রার মতন নিপুনতায় ঝোলার ভেতরে ইদ্রিসের হাত তন্নতন্ন করে খোঁজে , ফের বুকপকেট-প্যান্ট হাতড়ানো , ঘোরগ্রস্থের মতন ফের নিজেকে সন্দেহে আবার সেই হাত ঝোলার ভেতর খোঁজাখুঁজি করে ও ব্যার্থ হয়, অতঃপর হতাশ হয়ে কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের খাপ খুলতে গিয়ে আরেকটা ছোট খাপ পায় , সেই খাপের ঢাকনা খুলতেই সে আরও হতাশ হয় সিগারেটের অনুপস্থিতিতে এবং কাগজ মতন কিছুর আন্দাজ করতে পেরে সেটায় হাত বোলাতে থাকে । কিছু বোঝার চেস্টা করে স্পর্শে আর আন্দাজে এবং ঝোলায় চালান করে মলিন মুখে ফের হাঁটা সুরু করে অনিশ্চয়তার আর অন্তহীন কৌতূহলের দিকে ।


সেই রাতটা কাটল হেমকুমারীর হাটখোলায় । বিকালবেলা গাইবকের পক-পক-পক শব্দ আর বড় পাকুরের আঠালো পাতার গন্ধ পেলেই কেমন বুক চিনচিন করে মনে হয় এই বুঝি বারবেলায় হাটের জোগাড় বসবে , সাতগাঁয়ের খদ্দের আর ব্যাপারীদের জমজমাটি হবে ! সে কান খাড়া করে আন্দাজ করার চেষ্টা করে যদি একটাও হাঁক দেয় কেউ ! হোক না ক্ষীণ , তবু যদি কেউ থাকে , যে এখনও হয়ত এ-হপ্তায় বিস্যুতবারে হেমকুমারীহাটের আশায় বসে, দুটি লোকের সাথে কথা বলার আশায় সেই সকাল থেকে পথ চেয়ে আছে , সে পশার আনুক নাই আনুক , কিছু কিনুক আর নাই কিনুক , দূর মেখলিগঞ্জের আদিচর তারও ওপারের বহুক্রোশ দুরের কোন গ্রাম যেখানে যুদ্ধ হয়নি গত মরশুমে , যাদের মাঠের আউশক্ষেতে এখনও কিষান হেঁটে বেড়ায় , যাদের দহলায় দহলায় সন্ধ্যে নেমে এলে চরে ফেরা মোষের গাঁয়ে চোরকাঁটার জীবন্ত গন্ধ লেগে থাকে – কেউ মৃদু হাঁক দিলে তার সাড়া পাওয়া যায় সহজে সেই গ্রামথেকে এসে বসে আছে হয়ত শুধু দুটি কথা কইবে এই আশায় !
রাস্তা ছাড়ার সাহস তার নেই , সামর্থ্যও নয় ! গাঁয়ে বনবাদাড়ে মানুষজন কই যে ভরসা করে দুটি পা এগোয় ? সারা হাটখোলায় একটা কুকুর আর কিছু কবুতর ছাড়া সারারাত কারো দেখা নাই , যদিও দেখা পাওয়ার কথাও না । কুকুরটার অবস্থাও তার মতন ; কদিন যে খায়নি কে জানে! এত মিনমিন করে কুঁইকুঁই করে যে কুকুর না ডাহুকের বাচ্চা বোঝা মুশকিল । শুধু মায়া হয়না , চু-চু শব্দ করে কাছে ডেকে মাথায় আদুরে হাতবুলিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হয়না, তাকে নিয়ে কৌতূহল অবধি হয়না বেশিক্ষণ ; শুধু তাকে ঘিরে যে সারাক্ষণ কুকুরটা গোলগোল ঘুরে চলছে আর কিছুর অপেক্ষা করছে সেই অনুভুতিটুকুই আনন্দদায়ক মনে হয় ; সে অনুভুতি বিপুল বিষাদভরা আনন্দের ; নলপুকুরির ইসমাইলচাচা গত হল এক শীতে , তার হপ্তাখানেক আগে ঘরের দুধে বেড়াল মুখ দিয়েছে বলে সেই পোষ্যকে খাবারের লোভ দেখিয়ে কাছে ডাকে বুড়ো, ইসমাইল যে লাঠি ভর করে সারাদিনে মাত্র দু’পা হাঁটে কাশতে কাশতে সেই লাঠির দিয়ে তারপর মার লাগায় বিড়াল কে, ক্ষুধার্ত বেড়ালের বুঝে ওঠার অনেক আগে, সে যে কি মার মারল হায়রে হায় ! খালেফার আম্মু দেখেছিল দরজার আড়াল থেকে , রোগা মরণ ভর চাপা বুড়ো তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ঘোরগ্রস্থের মতন ওইটুকু বেড়ালকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেড়েছিল , দাঁতে দাঁত চিপে বুড়ো সেদিন যে কার রাগ নিয়ে বেড়ালের ওপর শোধ তুলেছিল কেউ জানেনা কিন্তু খালেফার আম্মু বলে বুড়োর চোখ নাকি তখন জাহান্নমের সয়তানের মতন জ্বলজ্বল করছিল আর ঠোঁটের কোণ নুইয়ে লালা ঝরে আসছিল , সেই মানুষটারে তখন চেনা দায় , তার যে রোগ আর সে যে আগের কয়মাশ বিছানায় মরার মতন পরে ছিল সে বোঝা অসম্ভব , এর কয়দিনেই ইসমাইল চাচা তারা হয়ে ঈশান কোনে চুপচাপ মিটমিট করে আর তামাম দুনিয়ার দিকে তাকায় উদাস হয়ে চেয়ে থাকে, খালেফার আম্মু কয় সেই বিড়ালের ডাক নাকি মাঝে মাঝে তাদের পাঁকশালের পেছন দিকে শোনা যায় রাত হলেই, সে তখন সে দিকে তাকায় না , মুখে রা কাড়ে না, শুধু না শোনার ভান করে দুই টুকরা রুটি ছুঁড়ে দেয় । হেমকুমারির সেই জনহীন হাটে পৃথিবীর শেষ উদ্বাস্তু ইদ্রিস আলির যেমন মিনমিনা কুকুরের ডাক শুনে মায়া হয়না , তার যেমন এক শয়তানের কলিজার মতন বুক চিনচিন করা আনন্দ হয় , তখন ইদ্রিস আলি ভয় পায় , অন্ধ সঙ্গিহীন ইদ্রিস আলির বুক ছমছম করে ইসমাইল চাচার কথা ভেবে , চারকোণের কোন গঞ্জে যে মানুষ নাই এই বাস্তবতা তখন তাকে কষ্ট দেয়না আর , ভীত করে , সে যে কিসের ভয় সে আন্দাজ করা মুশকিল !! জুবুথুবু মুখ করে কেমন আশমানের দিকে তাকায় , তারপর মাথা ঝিমিয়ে এলে ঝাপবন্ধ দোকানের দাওয়ায় কখন অজান্তে ঘুমিয়ে পরে ।
মাঝরাতে বৃষ্টি নামে , শীত করে তার , হথাত্ ঘুম ভেঙ্গে মনে করার চেষ্টা করে সে কোথায় , ঝোলার ভেতর থেকে হাতড়ে একটা কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে নেয় চাল বেয়ে আশা জলে তারপর শুষতে থাকে সেটা পাগলের মতন , অতঃপর আবার ভেজায় আবার শোষে , হাফিয়ে গেলে ফের ঘুমিয়ে পরে কখন !

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন