মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

হাতিয়ার বিলে কত জল দোস্ত ? কত লোকে বিষাদের গান গায় হাওড়ে - হাওড়ে ?


প্রিয় সরখেলপাড়ার খেলার সাথীরা - অন্ধকার দিনে চরের পর চর  অতিক্রান্ত করা বন্ধুরা - প্রিয় বেদের দলের কালো মেয়েটি - প্রিয় মাঝি-মল্লার দল - জ্বরের রাতে গাঢ় স্নেহের ছায়ামানুষেরা - চৈত্রদিনে অপেক্ষারত প্রিয় প্রাক্তন প্রেমিকারা - হেদুয়ার প্রিয় বন্ধুটি যার সাথে আর কখনো দেখা হয়নি পাঁচবছরে - প্রিয় কলকাতার খাবার ভাগ করে নেয়া বাকির খাতার খরিদ্দারেরা - প্রিয় উন্মাদের দল  - শেকড়হীন বন্ধুরা - প্রিয় চয়ন , যাকে  একটাও রুশদেশের রূপকথা পাঠাতে পারিনি - প্রিয় বানারহাটের শালবন - সোনাডা'র রাস্তায় হারিয়ে ফেলা গল্পের প্রিয় চরিত্রেরা - প্রিয় পত্রপ্রেরিকারা - উত্তরহীন প্রিয় পত্রপ্রাপকেরা - প্রিয় বড়দিদি - প্রিয় নগেন জেলে - গজেন্দ্রপুর চৌরঙ্গীর লটারির প্রিয় দোকানি - প্রিয় আসমা পারভীন - প্রিয় ছোটবেলার বন্ধুরা যাদের সাথে আর কথা হয়না অর্ধদশক - মিছিলের প্রিয় মুখেরা - মাটির গন্ধ লেগে থাকা প্রিয় আত্মীয়েরা - আত্মহত্যা করা প্রিয় কবিরা - রবিচাষের শেষে স্বপ্নবোনা আমার পূর্বজনেরা - প্রিয় হাড়ির  ফেরিওয়ালা - প্রিয় তিস্তাপারের  বর্ষা ,

ভালো নেই কোনোকিছুই । বেঁচেবর্তে দিন চলে যায় কোনমতে ।
গল্পের পর গল্প , অসংখ্য চেনা বা অচেনা প্রিয় মানুষের স্মৃতি , কলকাতার ভিড়ভর্তি ক্রমশ ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে নিজেকে বয়স্ক মনে হয় এখন। আগাছার মত বাড়তে থাকা জঞ্জাল মনে হয় নিজেকে ; কোথাও কোনও টান নেই , কেউ কোথাও অপেক্ষা করে নেই , কারুর কিছু যায়-আসে না - নিরন্তর ফ্যাকাশে দিনযাপন একমাত্র ধ্রুবক এখানে।

বহুদিন বাড়ি যাওয়া হয়না । মাঝে মাঝে ঘোরের মত পুরনো দিনের কথা মনে পরে । চৈত্রদিনে শিমুলতুলো উড়তে দেখিনা কতবছর ।  ঢাকুরিয়া লেভেল ক্রসিং-এ ভোরবেলা কলকাতায় কাজ করতে আসা মহিলাদের ভিড়ে কারো মুখ দেখে হঠাৎ মনে হয়, 'বড়দিদি না?' ; দুপুর রৌদ্রে ক্ষুদিরাবাদের আরও পুবদিকে ঘুরতে যাওয়া হয় বেশ; বহুতল ঘরবাড়ি কমে এলে জলাজমি আসে, পিচরাস্তা তখনও শেষ হয়না ; মুখ থম্থমে হয়ে ওঠে গরমে , নিজেকে যন্ত্রনা দিয়ে আজকাল কেমন এক সুখ পাওয়া যায়। তারপর দুটো তালগাছ-অলা পুকুর দেখা যায় ; কিছু মোষ কাদায় ডুবে; ঢোলকগ্রামের নুড়ির রাস্তা মনে পরে । মামাবাড়ির কথা মনে আসে । মা যে স্কুলে পড়ত , ঠিক সেই স্কুলবাড়ির মতন সাদা দেয়ালের দুটো ঘর , একটা বটগাছ । বেখেয়ালে ঠিক করি , এইবারে নিশ্চয় বাবাকে না-লিখে ওঠা চিঠিটা পাঠাতে পারব । বলে দেব অনায়াসে , আর কিচ্ছু না-নিয়েও ভিখিরির মতন আমায় ঘরে ফিরতে দেয়া হোক ।

ছোটবেলায় গ্রামের এক পাগল চিরকাল এক কথা বলে যেত , তার শুরু নেই , শেষ নেই, পরিনতি নেই , শুধু সেই একটা বাক্য , 'পালাবো শিমুলপুর , আমিনার বাড়ি যাব !' ; একথার মানে আজকাল দিব্যি বোঝা যায় ! শীতের গমকাটা শেষ হলে ছাপরা, মুঙ্গের , গয়া , মধুবনি থেকে যেসব বেদের দল উত্তরবাংলা আসে, বর্ষার আগে দু'মাস সাপের খেলা দেখিয়ে যায়; দুটো পয়সা জমিয়ে ফের খারিফের আগে হাওয়া হয় তারা । এইবার কোনো বেদের সাথে দেখা হলে শিমুল্পুরের ঠিকানা জিজ্ঞেস করব , আমিনার বাড়ির খোঁজে ! তারপর মৌসুমি মরশুমে শিমুলপুরের  ঘেসো মাঠে পাগলের মতন দাঁড়িয়ে থাকব , বৃষ্টিমাসের গান শুনব ; বিদ্যুতের ছলকে ব্যাং ডাকা শুরু হলে যখন মেঘ ঘনিয়ে আসবে , ছোটবেলার বৃষ্টির গন্ধ নিয়ে দমকা হাওয়া যখন সমস্ত শুকোতে দেওয়া নীলরঙ্গা উত্তরীয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে , দরজার কাছে এসে ফিশফিশিয়ে আমিনাকে বলব চল পালাই 


এই সবকিছু ছেলেমানুষি মনে হবে হয়ত । আসলে নতুন করে বলার মতন কিছুই ঘটেনা এখন আর ।