শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭

‘কুদ্দুস সাহেব , বুকের কলিজা কেটে দিলে এইবারে বিপ্লব হবে তো?’ : ছাতা আবিস্কার ও একটি গুপ্তহত্যার গল্প

                                                          © Bernhard Lang 

১.
বিগত শতকের রেলগুমটি থেকে উঠে এসে মরিয়ম প্রশ্ন করে তোমাদের এই ভাগাভাগির রাজত্ব কবে শেষ হবে ?
‘গ্রাম উঠে এসেছে শহরে’
লোহালক্কড় , চাল-গমের মালগাড়ি আর ট্রেনভর্তি নয়া উদবাস্তুর দল এসে শহরে ছোটে
লুটোপুটি খায় বিজ্ঞাপনের দেয়ালে দেয়ালে
শহরতলি-গামী শেষ ট্রেনগুলোয় ঝিমোয় আর ঝিমোয়
এদের ঘরে ফেরার আনন্দ নেই –
পুরাতন কোন মুক্তিদিনের স্মৃতি নেই -
মৃত্যু কারখানা থেকে এক একটা ঘরমুখো জীবন্ত লাশ ফের মরে গিয়ে আগামী আবার ছুটবে – ছুটবে আর ছুটবে
শতাব্দীর পর শতাব্দী রোমের রাজপথে
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
পম্পেই নগরীতে , হরপ্পা , ইনকার প্রত্যেক প্রোথিত পাথরে
তেলের দেশে দেশে , আজারবাইজানে কোন নিষিদ্ধ নগরীর দালানে দালানে
রাজারহাট , টেকনোপলিস – সবকটা হাইওয়ে – ফ্লাইওভার – এদের রক্তের রঙ জমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলে
রোজ মরে গিয়ে রোজ বেঁচে উঠবে হাওড়া আর শিয়ালদহের প্রথম লোকাল ধরতে
তারা জানে তাদের মাথা নত হয়ে আসে
তারা জানে গতশতকের শোক রেলগাড়ির চাকায় চাকায় প্রমাদ গোনে দীর্ঘ – নিরবিচ্ছিন্ন ।

২.
উত্তরে যাও , বুঁজে যাওয়া ক্যানালের ধার - চাঁদ সদাগর – ধাপার মাঠ এলে
পঞ্চান্নগাঁয়ের ঝিল থেকে উঠে এসে মরিয়ম জানতে চাইবে এখানে যাদের বাড়ি, এখানে তাদের বাড়ি কিনা !
বাইপাস ধারে বাবুরা স্বপ্ন বুনেছে উড়ালপুল আর খাম্বা
গ্রাম তোলপাড় করে বাড়তে থাকা একতলার ওপরে অনেক তলা
একরকম দেখতে সড়কগুলোয় একরকম মনের
মানুষের একরকম দালানে দালানে
দশলাখ ইটভাটার চোখের পানি আছে
বিশলাখ রাজমিস্ত্রির গুপ্তখুনের সারমর্ম লেখা আছে
ঝকঝকে তকতকে কাঁচের দেয়ালে দেয়ালে
বিশলাখ শ্রমিকের সাথে বেঈমানির প্রলেপ দেয়া আয়নায়
আমরা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাইনা এখন !

৩.
তারপর , একদিন আবারো রাষ্ট্র এসে বললে
দু’টাকায় চাল নাও , দক্ষিণে তো দরিয়া , দরিয়াই মুক্তি
প্রথম শিবির বনবাসে বহুদিন , তাই দ্বিতীয় শিবির এসে নৌকো বানিয়ে দিলে ; জনতা যখন বুঝল নৌকো ফুটো কাঠের
ঠিক সেই সময়ে তৃতীয় শিবির এসে জানালে ,
‘রঙ চাইনা , ঝান্ডাও সেকেলে , দরিয়া যখন নাই
নৌকোর কি বা প্রয়োজন ! মাথামোটা মতিভ্রমে নৌকার স্বপ্নে দেখে !’
তৃতীয় শিবির হুংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘তোমাদের শুধু শেকল আছে ! আর কিচ্ছু নাই ! শুধুই শেকল , একটা গোটা ! শেকল ছিঁড়লেই চিরমুক্তি। বেশি ভেবে কাজ কি ?!’

এই বলে তৃতীয় শিবিরের প্রত্যেকে ছাতা নিয়ে এল । কিছু হোক নাহোক , ছাতা বাড়লেই শেকলে টান বাড়বে বইকি !
দরিয়া তো নাই,  দুনিয়ায় ক্ষুধা নাই , ধান্দাবাজি নাই , দালাল নাই – এক আছে শেকল আর আমাদের সেন্ট্রাল কমিটি !
আইস , ছাতার দোকানে দিনবদলের দড়কষি !

৪.
ইতিমধ্যে হাহারকর এবং হোলহালকর-পন্থীরা এসে হম্বিতম্বি শুরু করল , তাদেরও চারদফা আছে বলে !
গঞ্জিকাহীন সাধু বিলিতি রামের বোতল পকেটে গুঁজে বললে , মোসলমান একবেলায় দশথালা ভাত খায়
প্রথম শিবিরের এক দীর্ঘ টিকা নধর টিকির বামুন এসে বললে,
‘গো-মুতের অভাব হলে দরিয়া শুকিয়ে যাবে ; মাতৃ দুগ্ধপান ও গো-দুগ্ধপান , উভয় সমান
অতএব, বাছুরে পেল কি পেলনা ভেবে কি লাভ , গো এবং মাতা উভয়ই মাতা !’
হোহোন হাগবত-পন্থীরা হাফপ্যান্ট খুলে ততক্ষণে জনৈক দলিতের মাথায় হেগে নিয়ে সায় দিয়ে জানালে , ‘বটে, বটে ! মোসলমানের গো-ভক্ষণ বন্ধ না করিলে , মুক্তি কই , মুক্তি কই ?!’
হাহারকর এবং হোলহারকর-পন্থীরা সকলে একযোগে অনুযোগ করল, ‘তোমার রাগ, তোমার ক্ষুধা , তোমার সবের দোষ মোসলমানের , দেখনা মোসলমান কোতল হলে সারা দেশ কেমন চুপ করে থাকে , অদ্ভুত নীরবতায় দেশ দেশ (দ্বেষ, দ্বেষ !!) বলে চীৎকার করে !’

৫.
তৃতীয় শিবির ততদিনে জাঁকিয়ে বসেছে ছাতার বাজারে ; তাদের মাঝবরাবর কাঠের তক্তার দেয়াল , কংক্রিটের দেয়াল হয়েছে এখন ; প্রথম এবং দ্বিতীয় শিবির কোন নড়াচড়া না করলে, এরা ছাতাতেই খুশি থাকে আজকাল ঢের বেশি !
অতঃপর মরিয়ম গত শতকের শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় ,
‘কুদ্দুস সাহেব , বুকের কলিজা কেটে দিলে এইবারে বিপ্লব হবে তো?’