সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬

মায়াকভস্কি তোমাকে

 



মরে যাওয়া নদীটার ধারে পশ্চিম দিকের আকাশে তাকিয়ে বুড়ো  খিরকীন লোরচা ভেবেছিল এবার থেকে ভালো মানুষ হয়ে যাবে।  উছল গাঙ্গে আশ্বিন মাসে কেমন বেমানান চরা দেখে তার নিজের মাথার চুল মনে হয় , কেমন পুরনো শুকনো , দুই কোমর-তিন কোমর বালি খুঁড়লেও জল পাওয়া যাবেনা যেন।
সরস মাটির মতন মনে হয়না ;
অবশেষ-চুলের ভিতর বিলি কাঁটলে নিজেকে জীয়ন্ত মানুষ মনে হয়না । 
লাশিন পশ্চিম দেশে বেপাত্তা হওয়ার পর কত বছর এরকম তাকিয়ে থাকত বুড়ো , দূরে গরম বালির ওপর , ঝাউগাছের জঙ্গলের ওপার থেকে ভরদুপুরের কোনো কম্পমান কালো ছায়া  দিগন্ত ধরে এগিয়ে এলে লোরচার চোখ জ্বলজ্বল করে , বুক ভরাট হয়ে ওঠে , একটা অদ্ভুত দলা পাকিয়ে ওঠে গলা বেয়ে আশায়। লাশিন ফেরেনি কোনদিনই  ; অভ্যাসের বশে রোজ মাঝবেলা  উত্তেজনা নিয়ে নদীর ধারে এসে বসে সে , বোবা হয়ে থাকে , ইতিউতি খোঁজে অথবা খোঁজার ভান করে সারাবছর , হাওয়ার সাথে বিলাপ করতে করতে  মরশুমি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে কোথায় যে হারিয়ে যায় ! অতঃপর বিকেল হলে তার ঘোর ভাঙ্গে খানিক। 
মল্লারপুর , পরামানিকের চরে শন কাটার মাসে অচেনা মানুষেরা ভীড় করে , সারাবছর উদ্বাস্তু হয়ে ঘোরা লোকেরা চালাঘর বানায় তখন, বালির উঠোনে সংসার পাতে বর্ষা না আসা পর্যন্ত  , চরুয়ারা রাতে আগুন দিয়ে শনের জঙ্গল পুড়িয়ে ক্ষেত করে, মল্লারপুরের শেষ সীমানা অনেক রাত অবধি লাল হয়ে থাকে সেই আগুনের রেখা বরাবর ; দিনের বেলা চকচকে কালো পিঠের বাচ্চারা হাঁটুজলের নদীর ওপর আহ্লাদি মৌরলার ঝাঁকের ছন্দে ছোটাছুটি করলে, কারো কারো মুখের গড়ন লাশিনের মুখ মনে করে কতবার তাকে খুঁজতে গিয়ে আবার হারিয়ে ফেলে বুড়ো , নাওয়া খাওয়া মাথায় ওঠে লোরচার তখন !
বুড়ো খিরকিনের ঝিমোনো রোগ যেবার হলো , তারপরের বচ্ছর তাকে পেল আরেক রোগে।  পরামানিকের চরা উত্তরে আরো চারমাইল লম্বা হল সেই শুখার সনে , দূর দূর গায়ের আরো কিছু লোক পাকাপাকি থান বসালো যার যার ; মহাল দাগালো থলকলমির বেড়া দিয়ে ; কোন আভাগা চাষা একদিন ভুলেই টাকা চেয়ে বসল ধারে তার কাছে  ; বুড়ো খিরকিন মানুষের এমন রূপ তো দেখে নাই আর কখনো , বাপ্ রে বাপ ! কি তার চোখের জেল্লা , মনে হয় এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে খুলির ভেতর থেকে ! ধারের টাকা পাওয়া সেই চাষার খুশির চেয়ে , লোরচার ঢের বেশি আকর্ষণ ছিল ও ব্যাটার লোভাতুর চোখ দুটোয় ; তারই মতন  শীর্ণ , নিষ্প্রভ আর মৃতপ্রায় আরেকটা মানুষ কেমন খোলস খুলে খুলে ধারের গল্প ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে বলতে কলিজার ভেতরের গোটা আরেকটা শয়তানের ফন্দিভরা মানুষকে আলতো করে এনে দাড় করালো খিরকিনের উঠোনে তারই সামনে আরেকটা নতুন গল্প শোনাতে ; সে মানুষ যেমন চতুর তেমন মিচকা সয়তানের মতন নিরাকার , তাকে যেদিকে ঘোরাও সেদিক ঘুরবে , যা মানাতে চাও তাই মেনে নেবে , তোমার কিসে কিসে  আপত্তি হতে পারে সেইসব আগাম আন্দাজ করে সেইমতন তোমার হাতের ওপর গড়াগড়ি খাবে , তখন তুমি তাকে কাতুকুতু দিতে পার , টোকা দিয়ে অস্বস্তিতে ভরাতে পার হামেশাই , থেঁতলে দুই হাতের তালুর মধ্যে দমবন্ধ করে মারতে পার অবধি অথবা কান মলে দিয়ে আকাশের দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে বলতে পার , দূর দূর অবধি ছায়া খুঁজতে বলতে পার দীর্ঘ ছত্রিশ বছর যেমন খিরকিন নিজে খুঁজেছে হারিয়ে যাওয়া লাশিনের ছায়া , নিজের মৃত স্বজনদের ছায়া দীর্ঘ ক্লান্তিকর শতক  ধরে , সে তাই করবে মুখ বুজে ; একটাও শব্দ করবেনা অভিযোগের !
সেই থেকে মল্লারপুরে রটে গেল খিরকিনের কথা , ধার দেয়ার লোক বুড়ো খিরকিন লাশিনের ছায়া খোঁজা ছেড়ে ,নদীর ধার ছেড়ে ধার-খোঁজা মানুষের ভেতর আরেক যে শয়তানের দেহ বসত করে , সুন্দর - সহজাত সয়তানের দেহ , তাদের গল্প শোনে সে এখন , পেয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতন করে লোক ছাড়ায় , ভেতরের ধান্দাবাজ সহজাত মিচকা শয়তানের ডেরা সেইটার সন্ধান করে বেড়ায় ।
কয় বিঘা জমিজমা আর কয়েকভরি যৌতূকি মাকরির মালিক খিরকিনের আসল কয়েকমাসেই ফুরিয়ে গেল।  আরো
বছরখান কাটল তার সেই পুরান ছায়া খুঁজে ; জৈষ্ঠ্য মাসে ভাটিপ্রহরে গরম জলের ওপর হাসফাস করা রঙিলি বরোলির ঝাঁক ঢেমড়ে সাঁতার কেটে বেড়ালে, নিজেকে সেরকম উদ্দ্যেশ্যহীন মনে হয় তখন তার , মনে হয় সে কখনো লাশিনের ছায়া সত্যি খোঁজেনি পশ্চিম দিকের আকাশে তাকিয়ে , খুঁজেছে অন্য কিছু !
মল্লারপুর , পরামানিকের চরায় সন্ধ্যেবেলা ধানভাঙ্গা কলের আওয়াজ পাওয়া যায় ; ঢেঁকির মিস্তিরিরা মহাল ছেড়েছে কবে কেউ জানেনা , ঐদিকে ট্রানজিস্টরের শব্দ , অধুনা আমদানি সাইকেলের বিচ্ছিন্ন সান্ধ্য বেলবাজি কাঁচা সড়কটাকে মাতোয়ারা করে রেখেছে ; সেরকম এক সন্ধ্যেয় সর্বস্বান্ত খিরকিন লোরচা পরামানিকের চর ছাড়ল , ওই মেখলিগঞ্জের কালো আকাশটার উল্টোদিকে , পশ্চিমে , যেদিক থেকে লাশিনের ঘরে ফেরার কথা ছিল , সেই পশ্চিমের আকাশের তলায় বসতির টিমটিমে আলো নিশানা করে হাঁটা লাগলো মন্দলঘাট রেলগুমটির দিকে ! দিনের শেষ ট্রেনটা কালো ধোয়া উড়িয়ে ছুটে যাবে শহরের দিকে কিংবা অন্য কোথাও।  হালকা বিজলীর আলোয় দিব্যি বোঝা যাবে একেকটা মানুষের অনেক অনেক ছায়া , প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম গভীরতায় বৃহৎ আরো বৃহত্তর ছায়া কেমন হারিয়ে যায় , কেমন একটা আরেকটাকে গভীর স্নেহে গ্রাস করে , খাদকের অপরিসীম সৃজনশীলতায় অধুনা নাগরিকের দল কেমন মেতে ওঠে পশ্চিমগামী রেলগাড়িতে ।  যদিও ইস্পাতের দুটো লাইন রেলপথের কোথায় মিলেছে কেউ জানেনা ; আপাত মিলন যে সামনেই কোথাও , তা যে-কেউ দেখে বলে দিতে পারে কিন্তু ওই রেলগাড়ি যতোই এগোয় , লাইনদ্বয়ের সন্ধি তত এগিয়ে চলে আর ছায়ারা ছুটে চলে দিবারাত্র , সীমাহীন আগ্রাসী যাত্রায় ! খিরকিন লোরচা তাদের সাথেই যোগ দেবে !

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন