বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

আড়ল সাগর তীরে


১.

লাশিন  , ও লাশিন  ! মেয্রামগুলের সাড়া পাওয়া যায় না যে ! মন তো কাঁদেনা আর ; কই  আগের মতন উদাস হয়না দরিয়ায়  !

 সারাদিন মাছধরা নৌকার ঝাঁক দুরে যেতে যেতে ছায়া হয়ে গেলে  শুনশান লাগে।  একপাড়া ঝাঁ-ঝাঁ রোদে কোত্থেকে একটা উদলা গায়ে ছেলে টই-টই করে এদিক ওদিক ছোটে ; শুটকির গন্ধে ঘন বাতাস , তখন মনে হয় বাবলা মাছের গন্ধ কথা বলে , জলের ভেতরে আমাদের সমুদ্দুরের পেটের রঙের গল্প বলে , অচিন মাছের কসরৎ করে সাঁতরানো দেখাতে চায় , হাঃ হাঃ ! ছেলেটা  পাগল , শীস দিতে দিতে ওই যে অন্তিলোপ আর রোমশ করসাক শেয়ালের জঙ্গল বারসা কেলমেজের দ্বীপ জুড়ে ওখানে হারায় ; তারপর আর নাগাল পাওয়া যায়না । আভনের জঙ্গলে হারানো বাছুরের খোঁজে যারা যায় তাদের কেউ একটা হাঁক দেয়না তাকে আর  সন্ধ্যেবেলা। তারপর হিম নামে , সমার্খান্দী মেঘ ওম  নিতে খিরকীন লোরচার ঘরের অনেক পেছনে দান্দিহুল্লা  উপত্যকায় ঘাপটি মেরে থাকে চুপচাপ ; তখন ও-ছেলের গায়ের ওপর জোনাকি খেলে , তা-দেয় , মৌরুশি পোকার দল গান গায়। জেলের দল তখনও ফেরেনা। কেউ একটা আলো দিয়ে যায় ঘরে । শুটকির বাস্ নিভে গিয়ে হরতনলতার বিষাদের কান্না নাকে আঁচ পাওয়া যায় , খুসবুদার , সুর্মাইয়ের মতন অন্ধকার আড়ল সাগরের তীর ধরে। লাশিনের আম্মিজানের একটাই  পুরান খত্ খোলা যায় হামেশাই  ।

            *                *                    *                    *                    *                    *                  *

সেই মাঝি মল্লার দল  কার্প আর জাঁদের মাছ ভর্তি  নৌকা নিয়ে ফেরেনি কোনদিন ।
তারও অনেক বছর পর মাখমুদের  যখন সবে গোঁফের রেখা স্পষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে , তার বৃদ্ধ দাদুকে নিয়ে অরাল্স্ক শহরে পাড়ি দিল সে শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া মাঝিদের সন্ধানে । তিনদিনের দিন তারা নুকুস শহর ছাড়ল । এরপর এলো শুষ্ক মরুদেশ । ইউরাশিয়ান নমাডিকদের কেউ এর আগে এই মরুদেশের গল্প বলেনি । জাহান্নমের অভিশাপ নিয়ে আড়াল দরিয়ায় কবে এই শুকান চরা জন্মালো খোদা জানে। দূর দূর যতখানি দেখা যায় লোনা বালু আর নাঙ্গা মরা দেশ - রুক্ষ। রোদ যত বাড়ে মাটি ফাটার শব্দ হয় চড়চড় করে , পূবে তিয়েনশান পাহাড়ে যে বুনো আপেল হয় , সেই আপেল কামড়ানোর শব্দের মতন মাটি ফাটার আওয়াজ । আড়ল দরিয়ার জৌলুস আর নাই !  যত মরুদেশ পার হয় মাখমুদ আর বৃদ্ধের বাড়তে থাকে বিস্ময় আর অরাল্স্ক পৌঁছনোর অনিশ্চয়তা । সপ্তম দিনে এক বুনো উটের দঙ্গল দেখা গেল উত্তর আকাশের সীমানায় , তাদের পায়ের ছাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আরো দূর পৌঁছলে অভিযাত্রিদ্বয়ের অনিশ্চয়তা ভয়ের রূপ নিল। এরপর যা দেখল গোটা দুনিয়ায় কেউ সেরমটি দেখেনি ! হায় রে হায় ! মাইলের পর মাইল শুখা মরুদেশে জাহাজের খোল পরে আছে , হেলে ভেঙ্গে বালুর ভেতরে ঢুকে , কোনোটা আধডোবা কোনোটা বালুর মধ্যে খাড়া হয়ে মরে পরে আছে এরম হাজার হাজার মাছধরা খোলানৌকা , বাহারি দশটনি শিকারী জাহাজ , পাশে লকপক করছে তার নোঙ্গর বলিতেই ; আর হওয়ার শনশন আওয়াজ হিম ধরিয়ে দেয় !  উটের পাল অনেক আগেই কোথায় পালিয়ে গেছে মাটির ছাপ রেখে , কোনো পাখি নেই , এন্তার ইউরাসিয়ান কাঠবেড়ালের পাত্তা দূর  থাক ! তারপর রাত্রি নামলে সেই জাহাজের কবরখানায় ওপর জান্নাতের তারাভরা আকাশ আর বাতাসের হাহাকার শুধু । তামাম দুনিয়ায় এত শুনশান  মহাল আরেকটা হবেনা বাজি রাখা যায় আলবাত্ । সমার্খান্দ , বুখারা , তামাম আফগানি রেগিস্তান এরচেয়ে বহুত আরামের । মাখমুদের ছোট্টবেলার কথা মনে পরে , যেইদিন আম্মিজানের মুখে অরাল্স্কের পানশালা আর মাছের আঁশটে গন্ধভরা বন্দরের গল্প শুনেছিল , সেখানকার বাহারি দাস্তারখান সাজানো খাবারের দোকানে যখন সন্ধের আলোয় গরম বেশবার্মাক আর সাশলিক কাবাবের   ভুরভুর করা ঘ্রাণে অরাল্স্কের আকাশ ভরে যেত সেই আকাশ বড় অচেনা লাগে  এখন । তার বুড়ো দাদু জবান হারানো ; কবেকার তামাটে হওয়া প্রাচীন কোনো যেন তাম্রপ্রস্তর যুগের নারী তার দাদী কাজাখ ভাষায় যে চিঠি লিখেছে , আড়ল মরুদেশে জাহাজের কবরে বসে  ; ক্ষয়িষ্ণু কাঠের আগুনে যতটুকু আলো হয় , তার ঢিমে হয়ে আসা ঘোলা চোখে সেই চিঠি পড়ার চেষ্টা করছে  বুড়ো । 
(ক্রমশঃ)
০৭/০১/১৬