শুক্রবার, ৩ জুলাই, ২০১৫

যা কিছু বলা যায়


লোহাগড় , কাড়লা, ০৪/০৭/১৫                                                                                                     
                                                                                                                   
    ইন্দ্রায়নী নদীর ধারে কাড়লা এলাকা । বাজা হাট থেকে লোহাগড় পার্বত্য অঞ্চল , বুনো ঝোপের পাদদেশ শুরু । তারপর আরও সর্পিল রাস্তা উৎরাই , কালো আগ্নেয় পাথরের খাঁড়া পাহাড় একপাশে , একপাশে কাঁটাগাছের জঙ্গল রেখে ঘণ্টা দুই হাঁটলে লোহাগড়ের দুর্গ আসে ; দূরে পবন নদী আটকে রাখা বাঁধ দিয়ে ; আরও দূরে প্রায় দেড় কিমি নিচে নিশ্চুপ অরন্যের নিস্তব্ধতা খুন করে পুনে-বম্বে এক্সপ্রেসওয়ের যন্ত্রকলরব । কেল্লার সিঁড়ি বেয়ে মিনিট পঞ্চাশ হাঁটলে ওপরটায় পৌঁছনো যায় ; ওখানে মেঘেরা খেলে বেড়ায় হরদম । ডানে বিসাপুরের দুর্গ, পেছনে পবন নদী , সবুজ ক্ষেত আর লালমাটির কোলাজ আঁকা – ভাগ ভাগ করা জমি বাড়ি অনেক নিচে ফেলে টেবিলের মত সমান কেল্লার মাথা আসে । ইতস্তত বৃষ্টিজমা জলের খাল । পবন উপত্যকার দুরাগত পাখির শব্দ আর মেঘের আনাগোনা ।এইরকম বৃষ্টিজমা জল সমুদ্রপৃষ্ঠের আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায় বড় শীতল , তিরতির করে কাঁপে । সেইখানে বসে লিখতে লিখতে কেমন ঘোর লাগে নেশাগ্রস্থের মত । লিখে এত সুখ আর পেলাম কই ! মাঝে মাঝে পাথরের খাঁজে কামানের ধ্বংসাবশেষ, বক্সারের যুদ্ধে যে কামানের নকশা ইতিহাস বইয়ে থাকে সেরম আকৃতির । যেসব স্থানে জল জমে , ওতে মৌরলার মত ছোট মাছ , কতক লাল রঙের ; জলে হাত , পা ডোবালে সুড়সুড়ি দেয় , দু- আঙ্গুলের এত কাছে আসে যে সহজেই ধরা যায় , এইসব মাছেরা হিংস্র মানবজাতির স্বারূপ দেখেনি হয়ত , যে কারনে আমাদের গাঁয়ে পুকুরের মাছ এরম পাত্তা দেয়না , পাখি এসে ঘাড়ে বসে দোল খায়না ভয়ে অথবা অবিশ্বাসে , সেইরকম বোধ এইসব মাছের এখনো তৈরি হয়নি হয়ত ।  কত শতক আগের এইসব দুর্গ কলরবমুখর ছিল – শিশুর কলতান – গোষ্ঠীবদ্ধ একটা পরিবার ছিল – পশ্চিমঘাটের অনেক উঁচুতে এইমতন কোন জলায় কেউ দল বেধে স্নান করতে আসত – এখন খাঁ খাঁ সব ; রাজার আভিজাত্য – ওপরে আরও ওপরে উঠে কেল্লা বানিয়ে বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে । তারপর একদিন ইতিহাস সব গুঁড়িয়ে দিল । এই শনশন তীব্র হিমেল হাওয়া – ইতস্তত মেঘে যেন শোক – সভ্যতার আদিতে মানুষ আগুন জ্বেলে যে স্পর্ধায় পৃথিবীকে নিজের বলে দাবিদাওয়া দেওয়া শুরু করল সেই স্পর্ধার পরাজয়ের গল্প শুধু এখানে – শতবছরের লড়াইয়ের গন্ধ – জিঘাংসা আর পৌরুষ দিয়ে কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস। পঙ্গু পবন নদী রাজার উত্থান দেখেছে , পতনও । কোনও এমনও দিনে এই মিনারভরা দম্ভের সভ্যতা অস্তাচলে গেলে এই পবন নদী ,এই পাহাড়টা , লোহাগড়ের তীব্র ধুসর শোকস্তব্ধ মেঘ – আবছা লালমাটির ক্ষেতজঙ্গল মিটিমিটি হাসবে – যেন সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে তারা । নিচের উপত্যকায় মৌসুমি মেঘ স্তরে স্তরে এসে জমছে  ; যেদিকটা বসে লিখছি সেদিকে রোদ । ক্রমে গোটা পাদদেশ মেঘে ঢেকে গেল । পাশের মৃদু ঝোড়ায় কেন্দ গাছে চিলের বাসা , দূর দিকচক্রবালে মা-চিল উড়ে এসে ঝপ করে গাছে বসছে । পশ্চাদে বাকিরা এগিয়েছে , কেউ হাঁক দেয় একটা ঢালের ওপার থেকে ।
            বিসাগড়ের কেল্লা যাওয়ার পথে অনেকটা জঙ্গলে মাঝে। সমতল জঙ্গল । অরজুন , জাম , কেন্দ আর কাঁটাগাছের বন । মাঝে মাঝে দোকান আসে । একটা ছাপরার ঘরে দোকান, দোকানির বাড়িও সেটা ; বিছানা , উনুন আর দোকানের পসার মিলিয়ে এক-ছাপরার ঘরে বাস। নিম্বু পানি – কাঁকর – পোহা বিক্রি করে।  যেহেতু এপথে লোক কম ও দোকানের অভ্যুথান-সম্ভাবনা বিরলতর তাই দূরে পায়ের শব্দ অথবা পর্যটকের আভাস পেলে হাঁক দিতে থাকে দোকানদারেরা । সেইরকম একটা দোকানের সামনে এক মহিলার অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থাকা কেমন দুর্বল করে দেয় হঠাৎ ; এইসব পাহারজঙ্গলের বান্ধবহীন বিচ্ছিন্নতা মানুষ সয়ে নেয় কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতার পীড়া সমস্ত চোখজুড়ে ভয়ংকর দৃশ্যমান হতে থাকে ক্রমশ যেন , স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর। অনেক ছোটবেলায় স্কুলফেরত বিকেলে দিদির চোখে , মায়ের চোখে এইরকম ঠিক এইরকম চাহনিই তো দেখেছিলাম । গৃহকাতর নই , যেটুকু রয়ে গেছে তা  শুধু টানমাত্র ; অনেকবছর তো  হল ঘরছাড়া , গৃহকাতরতা আর পীড়া দেয়না তাই। এইসব অজানা দেশে , লোহাগড়ের পার্বত্য অঞ্চলে কেমন যেন হঠাৎ নতুনপাড়ার কথা মনে আসে । লিখতে লিখতে যত ভাবি পুরনো নয় আরও নতুন কিছু চাই এবার , তত বেশি বেশি করে যেন উলটোদিকে হাঁটি , একরকমভাবে , সেইসব স্মৃতিকাতরতা জাপটে ধরে । মানুষ মুক্তি কেমন করে পায় ; তার যাবতীয় একরোখা ফিরে ফিরে তাকানোর পশ্চাদপ্রবণতা থেকে কেমন করে নিস্তার পেতে পারে সে আমার সত্যি জানা নেই । এইসব কেল্লা – রাজাহীন , মালিকানাহীন , জৌলুষ নেই আর কোনও কিছুর , তবুও কেমন মৃত দেয়ালের প্রত্যেক কালো ইটে তার প্রাচীন গল্প শুয়ে আছে উচ্ছল দিনের , উত্থানের আর পতনের – তাদের নিষ্কৃতি নেই , মুক্তির পথও নেই ! পৃথিবী অদ্ভুত বড় ! 

( চলবে ....)



 মাহুলী পশ্চিমঘাট , ০১/০৭/১৫

এইসব জলপ্রপাত , উঁচু খাঁড়া আগ্নেয় পাথরের পাহাড়দেশে , পশ্চিমঘাটের মরশুমী ঝোড়ার ধারে বসে সবকিছু কেমন অদ্ভুত বীরত্বে নাকচ করা যায় । আশমা পারভীন নয় , নয় অনেকগুলো কবিতার অবসাদ । চাওয়া-পাওয়া গুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর যেন । আসানগাঁও থেকে অনেক ভেতরে মাহুলীর এলোমেলো সর্পিল পথরেখা ছাড়িয়ে পথহীন অচিন গাছ , জনহীন ঝোড়ার পাথর পেরিয়ে যেখানে পথ আটকে যায় , শিশুর চোখের মত স্বচ্ছ বিষম সবুজের দেশ , অতীব ব্যাসল্টের পাহাড় সেখানে । কোনো লোভ নেই আর যেন , ক্ষেদ নেই ; নিজেকে চেনা যদি জরুরী হয় তবে এই ডাঁশপোকার জংলি কাঁকরোল-ফুলের দেশে দুরন্ত বিচ্ছিন্নতা স্বাগত ! কি পেলাম , কি বাকি রয়ে গেল তারও অনেক ওপরে তানাসীর রুক্ষ ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়দেশে মেঘের ছায়ামাখা উপলখণ্ডের ওপর শ্যাওলার মত নিজস্বতা চেনা কেমন খুব অবশ্যম্ভাবী মনে হতে থাকে যখন একটা নিশ্তব্ধ বনজুড়ে বৃষ্টি নামে , বোড়া গাছের ঝোপে, বইকালের পাতায় পাতায় একটা গোটা উপত্যকা জুড়ে শুধুই বর্ষণমুখরতা নিরবিচ্ছিন্ন অজানা বন্য পোকার আওয়াজ ; নাহ আর একটাও চেনা মুখ ভাববোনা আর, কোনো  প্রিয় স্মৃতি নেই আমার , প্রিয় কারো জন্য ব্যাকুলতা নেই ; সন্মুখে হাজার শতাব্দীর চেয়েও পুরাতন ব্যাসল্টের পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বলে দেব আর একটুও ভালবাসিনি তোমায় ;  নাগরিক যাবতীয় বেশ খুলে খুলে নিজের খোলস ছাড়িয়ে গভীরতর আরও কারো খোঁজ পাওয়া যায় ; সহজে খুব সহজে । রাঞ্ঝনা ঝোড়ার শব্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে ; আর লেখা যাচ্ছেনা , শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে নির্বাক সময়যাপন এত মধুর ঠেকেনি কখনও । পশ্চিমঘাট , মাহুলীর বনদেশ , ভরান্দের বৃদ্ধ পাহাড়  , অবাঞ্ছিত শ্যেওলার কাছে বড় কৃতজ্ঞ । একটুও বানিয়ে নয় এমন কিছু স্বীকারোক্তি এখানে সহজ বড় , সহজাতবোধের মত । ফেরার পথটা অন্যদিকে কি ; খুঁজে খুঁজে তো অনেক কাল ক্ষান্ত ; ফেলে ফেলে যাওয়া যাসব, মুল্যবান হয়ে থাক তার চেয়ে নাহয় !