শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৪

নক্ষত্রবাস্







আমার ঘরের  ভিতর অব্যক্ত খোলা চিঠিরা এলোমেলো উড়ে বেড়ায়। গজেন্দ্রপুর  চৌরঙ্গি'র চায়ের দোকানে পেট্রোম্যাক্সে  হাওয়া দিতে দিতে দোকানিটা অদ্ভূত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল ; বাক্সজুড়ে নারকোলের নাড়ু আর কুলের আচারভর্তি ডিবেটায় নিজের ছবি দেখেছি কি মনে পড়েনা খুব, ঘর ছাড়ার মরশুমে ! প্রকাশদাদা বাঁশবাগান ঘেরা আমির পুকুরে মাছ ধরত ছিপ দিয়ে ; নিজের ছায়া চিনত বসে বসে - ফাতনার ওঠানামা কেমন ঢেউ খেলাতো তার পাঁচদশকের পুরোনো  কিছুই না-পাওয়া মুখে। সেবার নাগেরবাজার ফেরৎ অটোয় এক হিন্দিভাষী যুবককে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখছি ; কানের পাশের শিরাগুলো ফুলে উঠেছিল তার ; ডপকা মুসাম্বি ছুরি দিয়ে কাটলে যেরম গলগলিয়ে রস বেরোয় চোখগুলো ঠিক সেরকম ; অটোর সার্সী জুড়ে ব্যস্ত শহরটায় কারো সময় হয়নি ফিরে তাকানোর। তাতাই বলে বাড়িতে তার পাশে কেউ শুতে চায়না ; সে নাকি বেড়ালের মত গুটি মেরে গায়ে লেগে থাকে। মাঝরাতে মা বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে বিছানা বদলায় আর বোনের মেজাজ। খুব ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরে যখন মামাবাড়ি যেতাম , তল্হিকুরায় হাটুজল ভেঙ্গে সোতা পেরোতে হত ; সোতার জলের ওপর ধানের শীস জুড়ে ফড়িং উড়ে বেড়ায় ; একবার ফড়িং ধরতে গিয়ে নিজের মুখখানা আরেকবার দেখেছি। আলেক্সেই মেরিসিয়েভের গল্প আমার কক্ষনো ভালো লাগেনি বরং সেই গল্প জুড়ে আষ্ঠেপিষ্ঠে যে উইলো পাতার রং বলা আছে যে মেয়েটি যুদ্ধে মুখপোড়া সৈনিক'কে কখনো দেখেনি অথচ তাকে প্রেমপত্র পাঠায় ; গুজবেরির ঘ্রাণে যার শৈশবের কথা মনে পরেছিল প্রবাসে ; উক্রেনের যুদ্ধবিদ্ধস্ত পুরুষহীন গ্রামে ঘরের মেয়েরা যেভাবে হঠাত খুঁজে পাওয়া এক অনাহারক্লিষ্ট নিখোঁজ বৈমানিকের নগ্ন  পুরুসাঙ্গে দৃষ্টিপাত করেছিল সেইসব ; অনেকখানি  সন্ধ্যেবেলার রুপকথা জুড়ে পুকুরের তলা থেকে কৌটোর ভিতর ভোমরার খুনের দৃশ্য আয়নায় আরেকটা বিম্ব রচনা করে। জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুরে সদ্য স্নান সেরে এলে তোমার কপালে ঘাম জমে গড়িয়ে পড়লে আমার মনে হয় আমিও গড়িয়ে চলি ; গাল -গ্রীবাদেশ পার হয়ে সুগন্ধীমাখা রুমালের মত তোমার বুকের গন্ধ পেলে আমি রুমালের গন্ধটাকেই ভালোবেসে গড়িয়ে চলেছি। সেই ঘামের বিন্দুর ভেতর নিজের ছবি দেখব এবার। পুবদিকের দেয়ালে ঘরের ভেতর যে অজন্তা ঘড়ি ছিল কালো রঙের , গত পঁচিশ বছর একটুও অনিয়ম নাহওয়া এক টেবিল এক চেয়ারে কাটানো  কেরানীর চাকরি করা বাবার রবিবারগুলোয় সেই ঘড়িটা থেমে গেলে আমার ভয় হত , খাটের ওপর জলচৌকি উঠিয়ে আমি তার ওপর দাঁড়াতাম - ঘড়ির কাছে কৌতুহলে মুখ নামাতেই নিজের মুখ দেখা যায় ডায়ালের কাঁচে। আমি তখন সময়ের কথা ভুলে ঘরটায় দৃষ্টিনিক্ষেপ করতাম। ওপর থেকে দেখতে অন্যরকম লাগে রোজকার একক দিনযাপনে । তারও কতদিন পর অন্ধকার রাত্তিরে লোডশেডিং হওয়া শহরে  আলো নেই ভেবে যখন পথে নামলাম তোমার হাত ধরব বলে নিজের প্রতিফলনহীন রাস্তায় , চেয়ে দেখি শুকতারা বড় উজ্জ্বল  ; সপ্তর্ষিমন্ডল    যাকে আর কখনো দেখিনি সেও বড় জমকদার সেই রাতে। আলো দেখে ভয় হয় আমার - ভীড় দেখে । ভেবেছি কোনো একদিন পথ হাঁটবো , প্রতিফলনহীন শহরে , প্রত্যেকে তার তার মত জনতার ভীড় ।  আবার হয়তো সেই জলচৌকির ওপর উঠে একদিন দেখব সমস্ত ঘড়ি থেমে গেছে। একে অন্যের মত নেই আর কেউ। আমি রুমালের ঘ্রাণ ভুলে যাব ; তোমার বুকের ভেতর রক্তমাংস বাদে যে আরেকটা তুমি লুকিয়ে ছিলে তার সুবাস নিতে নন্দনপুর - খয়েরবারী থেকে এক একটা আমি নেমে আসব ; যেই পুকুরের ধারে প্রকাশদাদা  মাছ ধরত সেইখান থেকে ; আর আমার ছোটবেলার প্রত্যেকটা রবিবার থেকে আমি আসব । আমরা ঘর বাঁধি ; একটা ঘরের ভেতর আরেকটা ; একটা মিথ্যে দেয়াল দিয়ে প্রলেপ দিই । একটা ফেলে আশা হারিয়ে যাওয়া চিঠির পাতা দিয়ে আরেকটা প্রতিফলন বানাই। তারপর মাঝরাতে ম্লানতম নক্ষত্রের আলোয় সেসব উবে গেলে আরেকটা গল্প  আঁকড়ে ধরি  কোনো অনিয়তাকার ভুলেযাওয়া নিয়ে ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন