সোমবার, ১৮ মে, ২০১৫

এপ্রিলের ডায়েরি


১.
সব ছোটগল্পের শেষের মত আর ক'মাসে কলকাতার আরেকটা ব্যাচ কলেজ ছাড়বে। যে ছেলেটার সাথে ছোঁয়াছুয়ি খেলতাম , যার সাথে স্কুল পালিয়ে প্রথম তিস্তায় স্নান করতে গেছি - যার জন্যে বানানো কার্ড ব্যাগে , স্কুল শেষের দিনগুলোয় তাদের কেউ যেন চেনা নয়  আমার ! গোলস্কুল ;  পুরোনো স্টেশনপাড়ায় ঘোরা মরশুমে যেন অন্য একরামুল - অন্য তুষার - অন্য আফরীন ছিল ওরা। কলেজের গত কয়েকটা বছর তোতলানো সাম্বা - চঞ্চল তিরুমল - সিরিয়াস অশ্বিনী - স্বপ্নের রঙের মতন এক এনসাইক্লপিডিয়া গল্পভর্তি ভূপেন কিস্কু - নবারুণ খোর খৈয়াম এরাও আমার অচেনা ; ঠিক যেন একশতাব্দী আগের পরিচয়। যে সাত্যকি এসে ইছামতীর জলের গল্প বলেছে নিউগড়িয়া রেলকলোনি চপের দোকানে বসে , তাকেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।  আর যারা বলেছিল সাদার্ন এভিন্যু জোড়ারাস্তার মোড়ে প্রথম কৃষ্ণচূড়া তোমার-আমার ; যাদের সুগন্ধি রুমালে ঘাম মোছা যায় অনায়াসে - একটা , দুটো করে অনেক সিগন্যাল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ময়দান - রেডরোড - ইস্টবেঙ্গল মার্কেট ছাড়িয়ে হাওড়ায় লোকাল ধরা সহজ যাদের সাথে তাদের মুখ ভুলিনি , শুধু মানুষগুলো বড় অচেনা। রোদ্দুরে দুবরাজপুর বড়সড়কে দূরে পিচরাস্তায় মরীচিকা দেখা যায় ; শীরিষের গাছ পাতা খসায় পুরোনো ; ঘুড়ি ওড়ানোর দিনে সেই এপ্রিলের দুপুরে এখন বড় গরম লাগে - হাঁসফাঁস করে উঠি ; নিজেকেও চিনিনা আর। 

২.
অনেক রাত্রিজাগা অবকাশ নিয়ে শিয়রে কথারা ভীড় বাড়ায়।  কাকে লিখব , কি লিখব ভেবে ভেবে দিনরাত্রি - গ্রীষ্মদুপুর ঘোরের মত মনে হয়। চিঠিপত্র বিনিময়ের আশ্বাসহীন পৃথিবীতে আরেকটা কাল্পনিক ছবি নিয়ে আঁকিবুঁকি  করা যেতে পারে বড়জোড় কিন্তু ছবি-সব  ভীষণ বোবা ; মুখ ফুঁটে কিচ্ছুটি বলেনা , অভিমান করে যুগের পর যুগ  ধরে। বব্ বলেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল সবে ; আমার ভয় করে সহস্র শূন্য ডাকবাক্স দেখে - ভীড় ভেঙ্গে কোনো চেনা মুখের গড়ন দেখে ; আমার ভয় করে হঠাত্ নাম ধরে কেউ ডাকলে। 

৩.
খলখলিয়ে হাসে। ডুয়ার্সের মাদার ফুলের রং গাঢ় হলে যাকে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় ; উন্মত্ত এপ্রিল-দুপুরের রোদে যার জন্যে তেপান্তরের মাঠ হেঁটে - জামার হাতায় কপাল মুছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়, তার সাথে আবার দেখা হবে বেলঘরিয়ার লোকাল ট্রেনে। সত্যজেঠু মদ খেয়ে যার কথা বলে প্রশান্ত হাসি দেয় - দেশভাগের গল্পের আগে নীলফামারী-মেক্ষর্টাড়ি রাস্তার বাঁকে সন্ধ্যেবেলা যাকে হারিয়েছিল , আরবছর সে ফোন করে জানতে চাইবে সত্যজেঠুর ক'টা দাঁত পড়ল - টাঁক কতবড় হল ! বালুরঘাট লাস্ট প্যাসেঞ্জারে ওঠা কিছু হিজড়ের দল কোনো  কিশোরের থুতনি চেপে আবার বলবে ওমা কি আদরমুখো ছেলে ! তারপর মাতুঙ্গার ভীড়হীন বাসে হিন্দুস্থানী কনডাক্টর মাথায় হাত বুলিয়ে ভাড়া চাইবে উদাস কোনো গৃহকাতর যুবকের। যে যেখানে যেরম ছিল গোটা হেমকুমারী গ্রামে তাদের সক্কলের তিষিক্ষেতে রবিচাষের মরশুমে ভরা ফলন হবে।  আশমা পারভীন ; আশমা পারভীনের লেখা একুশ শতকের চিঠি খুলে যেদিন তার হাতের গন্ধের মত অক্ষর পড়ব সেদিন আর কল্পনার রং নয় , রিজেন্ট এস্টেটের রাস্তা কলকাতার বৃষ্টির দিনের মত সুন্দর ; গোলপার্কের ভীড়ে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে হামেশাই। অমলকাকুর বাবা হারিয়ে গেছে ; মাঝরাতে ঘুমন্ত শিশু , স্ত্রী'কে রেখে বাড়ি ছেড়েছিল ; অমলকাকু তার খোঁজ জানবে একদিন। গত এগারো বছর একটাও কথা না-বলা বোবাসাধু তার সাধন ভেঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে ঘরঘড়িয়া হাটে যাবে মাছ বেচতে - গুড়ের জিলিপি শালপাতার ঠোঙ্গায় মুড়ে মথুরাবাগান টি-এস্টেটে জ্যোত্স্নার আলোছায়ায় পথ ভাঙ্গবে ; গল্প করবে ; চুমু খাবে । সারি সারি অটোর লাইন ধরে ক্লাস শেষে ছেলেটা আবার এসে দাঁড়াবে ; বাটার স্কচ্ ডাবল স্কূপ নেবে ; শতাব্দীর মত ধীরে চলা মিনিটগুলো ফুরিয়ে মুখে ব্রণ'র দাগ ভর্তি কালো মেয়েটা সেদিন সত্যি আসবে।  গোগোইয়ের কথা - থাঙ্গুলাল থংসাই গোগোই - মনিপুরের উপত্যকায় যে শীষ দিতে দিতে  মোষ চড়াত  , আর এইখানে হেদুয়ার ধারে গল্পের মত বিকেলে গীটার বাজিয়ে ছেলেটা গিরিশ পার্কের পুরাতন গলির দুপুরের সাথে  হারিয়ে গেছে। সেদিন স্কটিশ গেলে গোলার দোকানের সামনে সে ঠিক অপেক্ষা করবে নিশ্চয় ! পকেটে টান থাকলে ছোট নেভিকাট কিনবে দুটো। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন