বৃহস্পতিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৫

আমায় চিনেছ আকাশলীনা ?


আবার বোম্বে এলাম; নাগপুরের কমলালেবুর মত শীতের আবেশ গায়ে মেখে পশ্চিমঘাট - নাসিকের দ্রাক্ষাক্ষেত পেঁয়াজের আবাদ আর শুষ্ক দন্ডকারন্য পেরিয়ে । পৌষ মাস এসে গেছে অথচ ঠান্ডা নেই একটুও।  স্কুলে পড়ার দিনগুলো ; আমাদের অ্যানুয়াল এক্সামিনেশন শেষ হত মার্চ গড়িয়ে এপ্রিল এলে ; রাস্তার দুধারে কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে থাকত ; সাইকেল করে একছুটে বাড়ি ফিরেই তিস্তার ধারে চলে যেতাম। ধু-ধু  চৈত্রের মাঠে  কুলের মরশুম ফুড়িয়ে গেলে ন্যাড়া বিবর্ণ কুলগাছের তলায় চর-চরে রোদ্দুরে ঘূর্ণি উঠতো। কারা যেন শামিলারবসতের ওপারে দূরে দিকচক্রবাল জুড়ে সুপুরির বাগানের ওপর ঘুড়ি উড়াতো ; নতুন্পাড়ার মালিবৌ মাদারের গাছে ঘুটে দিতে দিতে হাত শক্ত করে ফেলেছে কতকাল ; মাল্পুকুরীর সোতায় কেউ মোষ চরাতে গিয়ে হাওয়ায় উড়ন্ত গামছা সরিয়ে দূরাগত উড়ন্ত ধুলোর  পানে চেয়ে দেখে ; কেউ দুপুরের জলপানের খবর নিয়ে এলো কিনা ! গোটা  শরীরে কেরম অদ্ভুত বিদ্যুত্ খেলে যেত ; প্রথমবার বাঁধনছাড়া মনে হত ; মনে হত ঘুঘুমারির পাঁচ ক্রোশের দহলা পেরিয়ে যাওয়া যায় চৈত্রদুপুরে কেমন অজানা কোনো বাতিক মাথায় নিয়ে। এইসব কালা ঘোড়া - ফ্লোরা ফৌনটেন - কোলাবার ধারে যত মাছধরা নৌকো দাড়িয়ে থাকে সকালবেলা - ক্লান্ত - মৃত মাছের আঁশটে গন্ধ নিয়ে - বোম্বেজুড়ে যত চাকুরিজীবি - যত আমলা যত ব্যতিব্যস্ত জনতা ঘুমভেঙে অবলীলায় যাবতীয় ভালোলাগা তোরঙ্গে তুলে রেখে ব্রাশ করে - স্নান করে চুল আঁচরায় - দুটো মুখে দিয়ে কাজে বেরোয় আর সব ভুলে - সেই সব ছাপিয়ে আমি সক্কালবেলার বারাপাওয়ে কামড় দিই ; কোথায় যেন কবেকার ফেলে আশা চৈত্রদিনের পলাশের হওয়া এসে দোলা দেয় - এইখানে পৌষ জুড়ে সারাবেলা। বিকেল হলে সমুদ্রের ধার ভালো লাগে। এখানে নীল নয় জল একটুও। অনতিদূরে সীগাল-এর দল হাঙ্গামা করে - ঝপ্ করে জলে পরে ভাসতে থাকে। প্রথমবার আমার সমুদ্র এই আরবসাগরের ঢেউ এইসব একবিংশের দুষিত তট ; ভেনিসের নীল নিয়ে আর ক্যারিবিয়ান সাগরের জলোচ্ছাস ভেজা নুড়ির মত কিশোরীর প্রেমের গল্প হয়নি কখনো। আবার বছরপর এইখানে আমার  অবচেতন জিজ্ঞাসা "আমায় চিনেছ আকাশলীনা ?" কোথায় দূরে মিলিয়ে গেছে।

এত বৃহৎ আকাশে মিলিয়ে যাওয়া জলরাশি দেখে ভয় হয় নিজেকে হারিয়ে ফেলবো ভেবে। সেবার দুয়ার্সিনি যাত্রা রুবাইয়াত ও অনেকে। লঙ্কা নামের ড্রাইভার। রাতে এক ঘরে বসে সে তার শিশুর কথা শোনালো - পৃথিবীর আর সবার মত সেই হতভাগ্য দরিদ্র মাতাল চালকের গল্প শোনার রাত্তির শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে লঙ্কা ; খাবারের ডাক পড়লে তাকে আর ডাকেনি কেউ ; আমরাও না ; গল্প শেষে যে যার মত ভুলে গেছি। রাতের খাবার  শেষে  সিড়ি  বেয়ে দোতলার ঘরে উঠব বলে চাদর জড়ানো শীতরাত্তিরের লঙ্কার লাল চোখ দেখে  আমার  ভয় করেছিল বড় ; বিস্মৃত হওয়ার যন্ত্রণা সারা পৃথিবী জুড়ে !একটাও কথা না বলে মাথা নত করে সরে গিয়েছিল।  এই আরবসাগর বড় মহান। কিচ্ছু মনে রাখার তাড়া নেই তার ; আফশোস নেই বিস্মৃত হওয়ার ! যুগের পর যুগ উপল খন্ডের ওপর নোনা বালু কোথায় হারিয়ে যায় কেউ মনে রাখেনা !  বিন্ধ্যপর্বতে প্রথম বেগনভলিয়া ফুটেছিল যেদিন দহিসার নদীর সুরমাই প্রথম ডিম দিয়েছিল ; যেবার দন্ডকারন্যে রাক্ষসের ঘুরে বেড়ানোর  গল্প - বাল্মীকি  রামায়ন লিখল - যখন শিবাজি আপেলের ঝুড়ি চড়ে জেলছুট হল; বিজাপুরে-গোলকুন্ডায় প্রথমবার সোনার খনি আবিষ্কারের ক্ষণে - প্রথম দুর্গের  ভিত বসানোর দিন এই মহাসমুদ্র সব চাক্ষুষ করেছে। সন্ধে নেমে এলে মেরিন লাইনস ধরে নোংরা নোনা জলে পৃথিবীর নিষ্পাপ শিশুর দল বিশ্বায়িত বহুজাতিক পলিথিনের জঞ্জাল ওলটপালট করে ; তট বেয়ে সারি সারি গগনচুম্বী - এইসব দম্ভের শতাব্দী যারা রচিত  করেছে প্রাচুর্যের পৃথিবীতে শিশুকে অভুক্ত রেখে , ইতিহাসে তাদের পরিনাম লেখা আছে। অন্ধকারে সীগালের দল হঠাত্ কঁকিয়ে ডেকে ওঠে। সুজন জানে সমুদ্র বিদ্রুপ করেছে !

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন